New

শ্বেতপত্র

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার ও তাঁর কবিতা

লিখেছেন: ফরিদ আহমেদ

১৯৭৪ সালে কবি দাউদ হায়দারের বয়স ছিলো মাত্র ২২ বছর। ওই তরুণ বয়সে তিনি একটা কবিতা লিখেছিলেন। 

দাউদ হায়দারের লেখা সেই কবিতার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে, এই অভিযোগে মোল্লাদের প্রবল রোষানলে পড়েন তিনি। বাধ্য হয়ে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। কিন্তু, পরবর্তীতে সরকারী সহযোগিতাতেই তিনি কোলকাতায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কথিত আছে, দেশে থাকলে মোল্লাদের রোষ থেকে তাঁকে বাঁচাতে পারবে না বলে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে কারাগার থেকে বের করে নিয়ে কোলকাতা-গামী প্লেনে তুলে দেয়। সেখান থেকে পরবর্তীতে তাঁর আবাস হয় জার্মানি। তিনি আর কখনোই নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারেননি।

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সচেতন মানুষ জানতেন, দাউদ হায়দার কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছেন। কিন্তু, কোন কবিতার জন্য কিংবা সেই কবিতার বিষয়বস্তু কী, সে বিষয়ে কারও কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিলো না। কবিতাটা হারিয়ে গিয়েছিলো। অথচ, এই কবিতার শুধু কাব্যিক তাৎপর্যই নয়, রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিলো অপরিসীম। স্বাধীন বাংলাদেশে  কবিতা লিখে নির্বাসিত হবার দুর্ভাগ্য এই কবিতার কারণে দাউদ হায়দারের হয়েছিলো। একটা ধর্ম নিরপেক্ষ দেশের মোল্লাতন্ত্রের হাতে নিক্ষেপিত হবার সেটাই ছিলো প্রাথমিক পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপ থেকে আজ আমরা কোন চোরাবালিতে নিক্ষেপিত হয়েছি, তা সকলেরই জানা কথা।

দাউদ হায়দারের সেই হারিয়ে যাওয়া কবিতাটা আমি পেয়ে যাই আকস্মিকভাবে। কয়েক বছর আগে দুই নির্বাসিত লেখক, তসলিমা নাসরিন এবং দাউদ হায়দারকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম আমি। সেই লেখাতে শিবব্রত নন্দী, যাঁকে আমি নন্দী দা বলে ডাকি, এসে জানান যে, পুরো কবিতাটাই তাঁর ডায়েরিতে টোকা আছে।

কবিতাটা ছাপা হয়েছিলো সংবাদ নামের একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতায়। ১৯৭৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি সেটা ছাপা হয়। শিরোনাম ছিলো ' কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়'।  নন্দী দা তখন বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি থাকতেন নাজমুল আহসান হলে। তখন নাজমুল আহসান হল ছিলো টিনশেডের। হলের কমনরুম থেকে কবিতাটা তিনি ডায়েরিতে তুলে নেন। 

আমি টরন্টোতে থাকি। নন্দী দা থাকেন গুয়েলফে। দুই শহরের মাঝের দূরত্ব একশো বিশ কিলোমিটারের মতো। ফলে, নন্দী দাকে অনুরোধ করি ডায়েরির পাতা থেকে  ছবি তুলে পাঠাতে। আমার অনুরোধে তিনি তখনই কবিতাটা পাঠিয়ে দেন আমাকে। ডায়েরির সেই পাতা থেকে দেখে দেখে টাইপ করেছি আমি। 

কবিতাটা বিশাল। বাংলা এবং ইংরেজি মিশ্রিত। নন্দী দার ডায়েরিতে কবিতাটা যেখানে শেষ, সেখানে লাইনের হিসাব লেখা আছে। বাংলা ৭৭ লাইন, ইংরেজি ১৬ লাইন, সর্বমোট ৯৩ লাইন। আমি টাইপ করার পর ইংরেজি লাইন নন্দী দার সাথে মিলেছে, বাংলা লাইনের সংখ্যা মেলে নি। আমার এখানে ৭৭ এর চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। কী কারণে এটা ঘটেছে, জানি না। যাইহোক, এখানে পুরো কবিতাটা তুলে দিচ্ছি আমি।

কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়

দাউদ হায়দার

প্রকাশকালঃ ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সাল

জন্ম আমার কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়

ভেসে এসেছি তোমাদের এই তিলোত্তমা শহরে

কল্পিত ঈশ্বর আমার দোসর; পায়ে তার ঘুঙুর; হৃদয়ে মহৎ পূজো

চুনকামে মুখবয়ব চিত্রিত; আমি তার সঙ্গি,

যেতে চাই মহীরুহের ছায়াতলে, সহি নদীজলে; ভোরের পবনে।

ঈশ্বর একান্ত সঙ্গি; জ্বেলেছি ধূপ লোবানের ঘরে। তার পায়ের ঘুঙুর সে

আমাকে পরিয়ে পালালো, আমি উঠলাম আমি।

ভেতরেও সে বাহিরেও সে; আমার আমি হয়ে চলেছি আমি,

মরণের নক্ষত্র দোদুল্যমান কালো ঘণ্টার রাজধানীতে বর্শার মতো দিন।

রাত্রির অলীক নটী, অন্ধদ্বন্দ্বে নাচায় ভাই; আমার বিশ্বাস ছিল

প্রতিধ্বণী নেই, তিমিরে আমার যাত্রা; দেখা হয় আলখেল্লায়

সজ্জিত মিথ্যুক বুদ্ধ; বসে আছে বোধিদ্রুমের ছায়াতলে;

যিশু আরেক ভণ্ড; মোহাম্মদ তুখোড় বদমাস; চোখে মুখে রাজনীতি,

আমি প্রত্যেকের কাছে পাঠ নিতে চাইলুম; তোমাদের চৈতন্যে যে লীলাখেলা

তার কিছু চাই এবেলা। দেখলো ঈশ্বর দেখলো আদম।

আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?

আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত 

জননী ছাড়া আরে কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।

আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।

আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;

আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের 

উপায় ছিল না।

আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা

বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি

একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)।

Everything passes, one day everything will go yet

We shall not recognize each other, and indirect love

remain hesitant as the desires of lifetime shall roam 

the winds and blue sky.

এই তো সনাতন নিয়ম; ব্যতিক্রম নেই পরিবর্জিত অজাত শত্রু আমার।

প্রেম সে কি? কোথায় থাকে? কার জরায়ু থেকে নেমে আসে?

কেউ নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো?

বারবার আমি বেয়োগের চৈতন্যে বাহু রাখি। স্মৃতি আমার অকাল পাথর।

জীবে প্রেম? মানুষে মানুষে ভালবাসা? প্রেম অশ্রু আমার

ভোঁতা। এ্যরিষ্টোটল, প্লেটো, আমার চৈতন্যে; তাদের চৈতন্যই

আমার বিশ্বাস।

নীটসের কথাই ঠিক; ঈশ্বর মরেছে আমার শৈশবে,

অতএব সে আমায় ঘুঙুর পরিয়ে পালালে সে আজ নেই,

তার জারজ সন্তানেরা অলীকের চৌমাথায় বসে পাণ্ডুর প্রেমের কথা বলে।

লোক জমে, বাহবা দেয়; ঔষধ কেনে; ঘরে ফেরে; দেখি সব ফিকে।

আমি জনমে জনমে শূন্য গর্ভে ফিরে আসি।

নূপুর মিশ্রিত অধীর সঙ্গীতের বিরহের কাল বৈশাখীর শ্বাশতের করি না বন্দনা।

আমাতে উল্লাস আছে লগ্ন নেই; সার্থক বুদ্ধিতে বিষ্ণু দে আজ করিঃ 

আমার প্রিয়; অপ্রিয় সুধীর দত্তও নয় বটে,

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এড়াতে পারেননি এ বড় দুঃখের কথা।

যুগল স্তনে যৌবন দেখা দিলে তুমি বল প্রেম স্মৃতি।

একি তোমার নিজস্ব অভিলাষ? মাঝে মাঝে রাত্রি কালে হেঁটে যাই;

কোথা যাই সঠিক জানি না।

পথ জানে না আমার গন্তব্য কোথায়; আমি তার কোন কেন্দ্রে গিয়ে 

আশ্রয় নেবো। এমন মমতা দেখে খুঁজে ফেরে চরণ চিহ্ন; চরণ চিহ্ন

সহসা হারিয়ে যায়।

শোণিতে খেলা নেই নিস্ক্রিয় নিশ্চল।

আমি তোমায় খুঁজেছি; সীমান্তে আত্মদান করেছ কিনা জানি না,

মহাকাল আমার পদতলে। নিমীলিত চক্ষে আকাঙ্ক্ষার স্পষ্টতা।

পুরানে আমার বিস্ময়; কি করে অসাধ্য সাধন করা যেত?

আমার বন্ধুদের চেয়েও বুদ্ধিদীপ্ত? আপন বিশ্বাসে আমার কাটলো

মিথ্যা তাই বলি, প্রেম মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা।

সব কবিই একই ফুটবল নিয়ে ঘুরছেন গোল স্টেডিয়ামে, রেফারী নেই

হ্যান্ডবল, ফাউল ধরছেন কেউ? আমরা দর্শক কিছুই বুঝি না খেলা দেখি

আশা মিটে গেলেই ঘরে ফিরি। গোল করার কায়দাও মনে রাখি না।

কিন্তু সবাই তো চৌকস খেলোয়াড় বলটা কাটতে পারেন ভালো;

তবে কেন ঘুরছেন?

সহীসের ঘোড়ার সাথে জীবনানন্দের দেখা হোলো একদিন

মধ্যরাতে আমার সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে গেলো-

মনে তার প্রেম ছিল?

মূল্যহীন মূল্যবোধের কতটুকু বিজয়?

আমি দৃষ্টির আড়ালে উচ্চরিনাঃ বলি বিশাল জনসভায়-

তিমিরে আমাদের যাত্রা; তুমি জানো না জানো কিছুই এসে যায় না

এই উড়ন চণ্ডীর, উড়নচণ্ডীরাই মহাপাগল, পাগলের কথার 

দাম বিশ্ব ব্যাংকও জানে না।

সাবিত্রী তুমি কি বহ্নির কাছে নতজানু হবে? অমরত্ব হারাবে,

এসে আমার হাতে হাত রাখো; অমৃতের দিকে চোখ ফিরিও না

তোমায় সামনে বসিয়ে মন্থর করে এঁকে যাবো

সমস্ত শরীর চুল চিবুক।

এখন আঁকাজোকা সব শেষ

সামনে যে অন্ধকার আগামী উৎসবে আরো দ্বিগুণ হবে।

প্রতীক্ষায় লাভ নেই, আমার বক্ষে মাথা রাখো শোন আগমনী বার্তা

কালো মৃত্যুর দিন সমাগত,

তুমি শান্তির প্রেমের কথা বলো। বলেছে আদমের সন্তানেরা শান্তি কোনদিন

আসবে না, কৌতুক নয়। অন্ধ সংসারে সেই  কোরে প্রেম।

পাতালে গিয়েছ কোন দিন? কিংবা আকাশ নীলিমায়?

দেখেছ এ্যাপোলো? মন্বন্তরে সেকি যায়নি ভেসে? স্বরচিত গানে

আনন্দ পাও? ইন্দ্রপাল লক্ষ কোরেছো কোনদিন?

বিজ্ঞাপন বড় সুন্দর একদিন কৃষ্টি হবে পায়রা আসবে কার ঘরে? কোন ঘরে

তোমারই স্মরণে?

তোমার মুখে স্তনে কিসের দাগ? ঘোমটায় কোথায় চলেছো তুমি?

পেছনে আমার ভাই; অন্ধ ছন্দে সেই কৃষ্ণ; রাধা নেই,

আমার পদপ্রান্তে নিঃসঙ্কোচে লুটাক আদমের সন্তান; ঈভের প্রেম

ফাঁদের অলীক প্রেমে আমি আলো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়

তোমাদের শ্বাশতীরে খুঁজে পাইনি। কেউ পায়না চলে গেছে,

সব চলে গেছে, চলে যায়; বুঝি তাই বলে যাই

Even when our eyes meet shall not recognize each other

Even we walk past each other we shall not see. One day

Our bodies shall be together. One day we shall be 

tern from the struggles of life.

We shall have the silent procession and move

towards a rebirth, and I shall call you again and

again. And when you do not answer I shall 

go to that phantom land 

when we shall stand face

in perfect union. One day

you and I shall go to that landscape. And

yet no one shall recognize other.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ