New

শ্বেতপত্র

চিঠির ইতিহাস ও সাহিত্যে চিঠি / মোকলেছুর রহমান



পৃথিবীতে কে, কোথায় এবং কখন প্রথম চিঠি লিখেছিল তা আজও অজানাই রয়ে গেছে। তবে তার আদ্যোপান্ত  খুঁজে বেড়ানোর  পথে-প্রান্তরে ঘুরবো।

চিঠি লেখা, ডাকযোগে সেই চিঠি পাঠানোর সংস্কৃতি প্রাগৌতিহাসিক ঘটনার মতো । প্রচলন আছে শুধু দাপ্তরিক চিঠি অথচ এক সময় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই ছিল হাতে লেখা চিঠি। প্রেম করতে প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমপত্র লিখতো, পিতা-মাতা সন্তানদের, সন্তানরা পিতা-মাতাকে, ভাই বোনকে, বন্ধু  আর এক বন্ধুকে, ছাত্র-শিক্ষক, এক রাজ্য প্রধান আরেক রাজ্য প্রধানকে কতই না চিঠি লিখত। প্রসঙ্গত বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের প্রতি এডওয়ার্ড টেলার এবং লিও শেলার্ডের লেখা বিখ্যাত আইনস্টাইন চিঠি যেটাতে পারমানবিক বোমা তৈরির প্রস্তাব ছিল।

আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ডাকাতির চিঠিও পাঠানো হতো তাই গল্পটা বলা যায়- 'অসংখ্য খুন, ধর্ষণ শত শত সফল ডাকাতি করেছে দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার হরমুজ আলী। তার ডাকাত দলের সদস্য সোনা মিয়া, কালা জাহাঙ্গীর, ট্যারা হযরত, জালাল মোচারুসহ আরও অনেকে। সময়টা আমাদের স্বাধীনতার কিছু বছর আগের।  হরমুজ আলী ডাকাতের, ডাকাতির চিঠি পৌছে গেল কোচ বিহারের জমিদার নাতি নারায়ণ কূন্ড'র বাড়িতে। সে সময় ধনাঢ্যদের বাড়ি ডাকাতি হতো চিঠি দিয়ে। দিন-ক্ষণ উল্লেখ করে।  এখনকার সময়ে যেমন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে  বিভিন্ন অনুষ্ঠান  করি তেমন আরকি।
নারায়ণ কূন্ড ভয়ে মহাভীত হয়ে পড়েছিল। কিভাবে এই অঢেল ধন-সম্পদ, সোনা-দানা, হীরা-জহরত, বিদেশ থেকে আনা অতি মূল্যবান সামগ্রী ও তার চেয়েও মহামূল্যবান প্রিয় সুন্দরী স্ত্রী এবং কন্যাদের রক্ষা করবেন। খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে, দিন-রাত নারায়ণ কূন্ড হরি হরি  জপছে, আর মনে মনে বলতেই আছে রক্ষা কর ভগবান, রক্ষ কর। এ দিকে ডাকাতির নির্ধারিত দিন-ক্ষণ সমাগত। হরমুজ ডাকাত সর্দার তার ডাকাতির অস্ত্র ও সরঞ্জাম, দলবল নিয়ে বিরাট দ্বিতল নৌকা ভাসালো উত্তাল ব্রহ্মপুত্র নদে, নারায়ণ কূন্ডের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে মাঝ নদে প্রলঙ্করী  জলোচ্ছ্বাসে  পড়লো ডাকাত দল। নৌকা একবার ডোবে একবার ভাসে, ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! তখন ডাকাত দলের এক নতুন সদস্য সর্দারকে অনুরোধ করে  বললো ওস্তাদ নৌকা ফিরান। দুধর্ষ, ভয়ঙ্কর সাহসী, নির্দয় সর্দার নৌকা ফিরে নিতে চাচ্ছিলো না। দলের সকল সদস্যের অনুরোধে সে বারই প্রথম  ডাকাতি না করে হরমুজ ডাকাত  সর্দার দলবল নিয়ে ফিরে আসে'। 

গল্পে গল্পে যেন চিঠির ছড়াছড়ি । আজ সেই চিঠির সংস্কৃতি ইতিহাস মাত্র।

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ চিঠির আদানপ্রদান করছে, ইলিয়াডে, হিরোডোটাস এবং থুসিডাইডিসের রচনাবলীতেও তার উল্লেখ সুস্পষ্ট। 

ঐতিহাসিকভাবে চিঠির প্রচলনটাও ছিল প্রাচীন ভারত, মিশর,  রোম, সুমেরীয় এবং চীনে। চিঠি ছিল পাঠ চর্চা, অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা,  বিতর্কমূলক  লেখা বা সমমনা অন্যদের সাথে আইডিয়া  বিনিময়ের পদ্ধতি। কিছু মানুষ চিঠিকে মনে করতো নিছক  লেখালেখি। আবার কেউ কেউ মনে করতো যোগাযোগের মাধ্যম। সাহিত্যে, পরিবারে,  দপ্তরে, রাজনীতিতে এমনকি ধর্মীও ইতিহাসে পাই চিঠি।
বাইবেলের বেশ কয়েকটি পরিচ্ছেদ চিঠিতে লেখা  তাছাড়াও ঐশিক বাণী যে নাজিল হতো তাও চিঠির নামান্তর।

আমাদের পূর্ব পুরুষরা কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে  গাছের পাতায়, গাছের ছালে, পশুর চামড়ায়, ধাতব পাতে লিখতো। পাতায় লিখতো বলেই এর নাম 'পত্র'।
নান্দনিক ও সুলিখিত চিঠি অনিবার্য কারনে উন্নত সাহিত্য হিসাবে স্থান করে নেয়। উৎকৃষ্ট উদাহরণ কবি রবীন্দ্রনাথের 'ছিন্নপত্র'।

সুদূর অতীতে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় অঞ্চলে মানুষ ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করতো। আকাশের তারা দিয়ে বোঝানো হতো রাত কিংবা তীর ধনুকের ছবি দিয়ে বোঝানো হতো যুদ্ধের বর্ণনাকে। ছবির মাধ্যমে মনের যে ভাব প্রকাশ করা হতো তার নাম পিক্টোগ্রাম। চিঠির বিবর্তিত রূপই পিক্টোগ্রাম। 

আমাদের উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকালে জানা যায় আগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য পাঠানো হতো কাসিদ বা ডাকবাহক।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কবুতর বা পায়রা দূরবর্তী অঞ্চলে খবর পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। সম্রাট চেঙ্গিস খাঁ তাঁর অধিকৃত রাজ্যগুলির সাথে যোগাযোগ সমুন্নত রাখার জন্য মাধ্যম ছিল কবুতর। এরপর যতদিন এগিয়েছে ডাক ব্যবস্থায় লেগেছে নতুন হাওয়া।

দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের শাসনামলে ডাক ব্যবস্থায় যুক্ত হয় ঘোড়ার ব্যবহার।  পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণী থেকে জানা যায় সেসময় দুইভাবে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। 
এক. পায়ে হেঁটে সাধারণ ডাক বিলি-বণ্টন ও অন্যটি হল জরুরি অবস্থায় যেমন কোনও বহিরাগতদের আক্রমণের সংবাদ এবং যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের সংবাদ প্রেরণ করা হতো ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে। মোটা দাগে ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার সংস্কার ঘটে শের শাহের শাসনামলে সোনারগাঁও থেকে সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ।

বিশ্ব সাহিত্যে চিঠি বা পত্র সাহিত্যের  উজ্জ্বল নিদর্শন-স্যামুয়েল রিচার্ডসনের 'পামেলা' ইংরেজী সাহিত্যের বহুল পঠিত একটি পত্রোপন্যাস। এছাড়া
গ্রিক পুরাণের পাশাপাশি ভারতীয় পুরাণ অর্থাৎ রামায়ণ-মহাভারতেও পত্র রচনার উল্লেখ আছে।

যেমন- মহাভারতের নল-দয়মন্তী উপাখ্যানে দয়মন্তী হংসের পায়ে বেঁধে পত্র প্রেরণ করেছিলেন রাজা নলকে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, পত্রের মধ্য দিয়ে মনের ভাব আদান-প্রদানের বিষয়টি বহু পুরনো।


ইতিহাসে যেমন চিঠির ব্যবহারের গুরুত্ব সীমাহীন, তেমনি  বাঙ্লা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে চিঠি বা পত্র সাহিত্য অমূল্য আকর। তাইতো রবীন্দ্রনাথ এর মতে,- 'চিঠির মাধ্যমে একজন মানুষ নিজেকে তুলে ধরতে পারে। মনের জরুরি কথাগুলোও আবার কখনো বকুনি চালানোর সহজ রাস্তাও চিঠিপত্র। আর এই পত্র বা চিঠির মাধ্যমে লেখক যে সাহিত্যে বোধ এবং একই সাথে রসের যে সঞ্চারণ ঘটিয়েছেন তাকে সাহিত্য কর্মে পত্র সাহিত্য বলে'।
বাঙ্লা সাহিত্যে চিঠিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক পত্র সাহিত্য। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প 'স্ত্রীরপত্র' পুরোটাই চিঠির আদলে লেখা, গল্প 'পোস্টমাস্টার'। এখানে  আমরা দেখতে পাই অজ পাড়া গাঁয়ের পোস্ট অফিসের  সঙ্গে জড়িয়ে নানান ঘটনাবলী। কোনও সাহিত্যিকের রচনায় ডাক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার আর এক অনবদ্য শিল্পকর্ম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের- 'ডাকহরকরা'। এ গল্পে আমরা দেখি এক নিষ্ঠাবান ও দায়িত্ববান ডাকহরকরা ও তার দুশ্চরিত্র ছেলের গল্প। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'রানার' কবিতায় অঙ্কিত হয়েছে  রানারের জীবন ও কর্মের বাস্তব চিত্র। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পত্রকাব্য 'বীরাঙ্গনা'।

কথা হচ্ছে চিঠির ইতিহাস, সাহিত্যে ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে চিঠির গুরুত্ব নিয়ে। আজকের এই  দিনে অর্ন্তজালের ব্যাপক প্রসার ও ইমেল, ফ্যাক্স,  মেসেঞ্জার, হোয়্যাটঅ্যাপ প্রভৃতি সোশ্যাল সাইটের সহজলভ্যতা ও জনপ্রিয়তা ‘চিঠি’ নামক যোগাযোগ ব্যবস্থা মাধ্যমের প্রাণ ওস্ঠাগত করেছে   ইতিমধ্যেই। তবু চিঠি বেঁচে থাক, পৃথিবী ও মহাবিশ্ব যতদিন টিকে আছে।










একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. আমাকে যে তুমি দুর্ধর্ষ চিঠিগুলো লিখেছো সেগুলোর কথা বললে না যে? তুমি এত খারাপ। তোমার এডাল্টচিঠিগুলো আমি বালিশের নিচে রেখে দিয়েছি। কাউকে জানাইনি, নিশ্চিন্ত থাক। চিঠিগুলোর কথা আবার কাউকে বলোনা যেন।

    উত্তরমুছুন

অমার্জিত মন্তব্য কাম্য নয়