New

শ্বেতপত্র

সুবীর সরকার: মাঠে যে লোকটি কবিতা চড়ায়/ অন্তর চন্দ্র


কবিতার মাহুত-বন্ধু সুবীর সরকার। কোচবিহারে থাকেন। সাহিত্যের খাতিরে ছুটে বেরিয়েছেন দেশে-বিদেশে। প্রান্তজনদের নিয়ে লিখেছেন কথার পদাবলী। মানুষের কথা বলাই যেন কবিতার কাজ কবিদের কাজ। তিনিও সেটাই করলেন। তার কবিতায় উঠে এসেছে মাহুত-বন্ধুর কথা, মইশাল-বন্ধুর কথা, গাড়িয়াল ভাইয়ের গরুর গাড়ি আর চা শ্রমিক বাবুলাল এক্কা, হস্তির কন্যা পার্বতী বড়ুয়া, লোলজি রাজার মেয়ে প্রতিমা বড়ুয়া, আব্বাস উদ্দিন এবং তোর্সা নদীর উতল হাওয়ার কথা। তিনি তোর্সা নদীর পাড়ের মানুষ। ভাওয়াইয়াময় তার জীবন। কবি দুই বাংলার উত্তর জনপদকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। ‌তিস্তাবঙ্গ এবং গৌড়বঙ্গ।‌ বাংলাদেশের উত্তরজনপদকে‌ তিস্তাবঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর জনপদকে গৌড়বঙ্গ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দুই বাংলা যেন একই সূত্রে গাঁথা। ভাষাও এক। রাজবংশী বা অম্পুরিয়া। সারা বাংলাদেশে ঘুরে দেখেছেন প্রতিটি জনপদের মানুষের চাওয়া-পাওয়া, বেঁচে থাকা, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং তার অন্তর্নিহিত অভ্যর্থনা। শুনেছি তিনি ঢাকা, রাজশাহী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, চিলমারী, কুষ্টিয়া, হিলি, দিনাজপুর, নীলফামারী, ময়মনসিংহ, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর ছাড়াও এদেশের ২২টি জেলা ঘুরে দেখেছেন।কুড়িগ্রাম সাহিত্যসভা আয়োজিত ‘হেমন্তের কবিতা উৎসব-১৪৩০’ উপলক্ষে তিনি অতিথি হয়ে এসেছিলেন কুড়িগ্রামে। তখন ঘুরতে এসেছিলেন চিলমারী বন্দরে। সাথে এসেছিলেন, ‘কথা লহরী’ পত্রিকার সম্পাদক কবি সৈকত সেন ও কবি দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য দাদা। পরে, অতিথিবৃন্দ এবং কবি আহম্মেদুল কবির ভাই ও সৌরভসহ আমরা বন্দরের চায়ের দোকানে চা আড্ডা এবং কবিতাপাঠ করেছিলাম। ঘুরে দেখিয়েছিলাম আমাদের চিরচেনা চিলমারী বন্দর‌।  ‌“ওকি গাড়িয়াল ভাই হাকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে” গুনগুন করে গাইতে গাইতে চারদিকটার ভিডিও ধারণ করছিলেন সুবীর দা। ‌দেবাশীষ দা তো ছবি তোলা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ‌এভাবেই কেটে গিয়েছিল ক্ষণস্মৃতির অনুভাবের —সেই সময়।

সুবীর দার “লোকশোলক” পড়েছি, গভীর ব্যঞ্জনাপূর্ণ রসময় কথার সম্ভার। ঘোর লাগার মতো ব্যাপার। সেই যে বইটা পড়তে ধরেছি, এদিকে বেলা বয়ে যাচ্ছে তবুও পাঠ শেষ করার নাম গন্ধ নেই। কখনো কখনো মনে হয়েছে এরকম সুখকর গদ্য আর মনে হয় কোথাও পড়িনি। তার কবিতাও পড়তাম জটিল এবং কঠিন কথার সংমিশ্রণে সহজ জীবনের অনুসঙ্গ কবিতার প্রেক্ষাপট‌। সহজসূত্রের মতো ঢুকে যাই পাঠাভ্যাসে। অথচ কী করুণ উঠে আসে তার থেকে বুঝতে পারিনা আবার বুঝেও যাই! কিন্তু অনুভবকে প্রকাশ করতে পারি না। যেন শব্দ ব্রহ্মের অপ্রতিরোধ্য নিয়মের ইন্দ্রজালে পড়ে গেছি। 

‘লণ্ঠন ও হাসপাতালের কবিতা’ নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন... 
“জঙ্গলে ময়ূর দেখে যারা হাততালি দিতে/ ভুলে যায়/ তাদেরকে কি পর্যটক বলা যায়!” আরো বলেন, “হাসপাতালের গেটে দারোয়ান মার্বেল খেলছে” এই কথাগুলো আমাদেরকে বারবার ভাবায়। কখনো কখনো বুঝবার ভাষা খুব কঠিন হয়ে যায়। পরক্ষণই মনে হয়, না, আমি তো সব বুঝি —এই তো কবির ইন্দ্রজাল। 

—এরকম একজন সহজ সরল রোগা-পাতলা মানুষকে দেখে, প্রথমত বুঝতে পারা মুশকিল উনি একজন শব্দ গাঁথার কারিগর। এর জন্য পড়তে হয়। শুধু শেখার জন্য না, নিজেকে জানার জন্যে। তাই এরকম মানুষের সঙ্গ পাওয়াটাও সৌভাগ্যের। দেখলাম ‘একালের কবিকন্ঠ’ তাকে নিয়ে একটা সংখ্যা করেছে— এটা হ‌ওয়া উচিৎ! প্রত্যেক তরুণ এবং প্রবীণ কবি ও সাহিত্যিকের রচনা নিয়ে লোকে প্রশ্ন তুলুক, সমালোচনা করুক, পর্যালোচনা করুক, আলোচনা করুক। ‘একালের কবিকন্ঠ’ ঠিক যেন সেই কাজই করছেন। ‌বিশাল পরিধি জুড়ে গোছালো সব কথার সমাবেশ। ‌

সুবীর দার কবিতা কিংবা গদ্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য বসিনি। বরং এই মানুষটিকে দূরে এবং কাছে থেকে কিরকম দেখায় সেটাই পর্যালোচনা করছি। ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মার বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমিতে যখন এই লোকটি অর্থাৎ সুবীর দা মনমুগ্ধ হয়ে বসে গান শুনছেন আর মনে মনে গুনগুন করছেন, ঠিক সেই সময় থেকেই তার সাথে পরিচয়। তখন সাথে শৌভিক বণিক দাদা এসেছিলেন। বেশ কয়েকবছর হয়। যখন শুনি এই মানুষটি ৪০টি কবিতার বই এবং ১৮ গদ্যের ব‌ই লিখেছেন— এতটা ধৈর্য্য এবং ধী-শক্তির সাহায্যে আরও অবাক হয়ে যাই। তার লেখার ব্যাপকতা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানার আগ্রহকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। একদিন এই তরুণরাই নতুন নতুন শব্দকল্পের জন্ম দেবে এবং ভবিষ্যতের গুরুদায়িত্বে পূর্ব সময়কার কবিতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবে। উঠে আসবে নতুন নতুন মহাপ্রাণ। কবিতার বিচরণক্ষেত্র‌ ভরে উঠবে সোনালী জলসায়। —এই আশা, এই ভরসা।

২১ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ