১.
কেবল সবুজ অনুপ্রাস
এই যে এখন।
প্রতিপ্রভ জ্যোৎস্নায় দূরবর্তী নারকেল গাছ।
আঠালো বাতাসের ভারে পরাঙ্মুখ।
মেঘ হয়েছে, বোধহয় মেঘ হয়েছে।
এখানেই কাল চড়ুইভাতি করার কথা।
তোমাদের ছাদে তুলসীগাছ আছে।
তোমার ঘরে তুলসীকাঠের বিডস্ দেখেছি।
তুলসীকে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলে সীতাস্বরূপা, তুমি বলেছো।
সেই তুলসীর কিছু সবুজ, তোমার শার্টে আছে।
সবুজ কিছু তোমারও আছে।
টু এইট এইট বাই ফিফটিনের নিচের
নীল পলিথিনে মুখ গোঁজা বেড়ালের যখন খারাপ লাগে, তখন তোমারও মন খারাপ করে।
আমার গলায় কাঁটা বাঁধলে প্রিটি শিওর, তোমার খারাপ লাগবে।
ভাবছিলাম তুলসীর প্রশংসা ক’রে তোমার জন্য একটা সবুজ কবিতা লিখবো।
শঙ্খের সাদা রঙ, কোত্থেকে পেলে, তা নিয়েও কথা বলবো।
এসব বলবার প্রয়োজন আছে।
এত সবুজ, এত সাদা... কোত্থেকে পেলে!
ঝিঁঝিঁর আলোয় যখন তুমি পড়ো, শাক্ত পদাবলি পড়ো,
আর যখন তুমি যাও, বটের ঝুরি ভেঙে ভেঙে তুমি যখন যাও,
এমন নির্জন মেঘতামস পুনরায় জাগ্রত হয়।
কেবল কিছু শব্দ আর সুর ফেলে রাখো,
‘সুকুমার সেনের বইতেই মোস্ট প্রবাবলি রয়েছে, একচালার প্রতিমা মানে যৌথ পরিবার!’
২.
১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে মারলিন
শীতের সন্ধ্যায় আমার শার্সিতে মেশে-গলে
কণ্টকী শীষফুল।
মৃত মাছের সান্ধ্যোৎসবে ভায়োলিন বাজায় পুওর সান্তিয়াগো।
কেবল তোমার স্যালাইভারি গ্লান্ড থেকে একে একে তুলে আনি সুতো, বুনি মনস্তাপের জাল।
নরম-মার্শমেলো চোখ তোমার
তিষ্যরক্ষা করতে চায় আমাকে বারবার।
আমি এক প্রকাণ্ড মারলিন।
তুমি বোধহয় গেঁথে ফেলেছো।
হাঙর-ভরা সমুদ্রে কোথায় হাঙর?
কখন করবে বিশাল হাঁ? কুটকুট করবে, ছিঁড়বে...
কখন পাড়ে পৌঁছাবে আমার কঙ্কাল?
সান্তিয়াগো!
৩.
ভাদ্রের দ্বিতীয়দিবস
এখানে বসন্তপুর পেরোলে প্রেমতলী।
পথের ধারে আকন্দ আর কাটসুরা।
ছড়ানো-ছেটানো বরেন্দ্র’র ল্যান্ডস্কেপ।
আলকাতরার তীব্র গন্ধের সাথে মেশে দূরবর্তী গ্রামের খেজুররস জ্বালের ঘ্রাণ।
এখনও শীত আসেনি।
তিতাস একটি নদীর নাম কি পদ্মা নদীর মাঝির চেয়ে বেশি সুন্দর?
তুমি কীভাবে কল টেনে জল খাও…
আঁজলাভরা জল দেখতে ভালো লাগে।
বিশাল বট আর পাথরকুচির পর
চুমু ও চাঁদের দ্বৈত সন্ধ্যাসঙ্গীত।
৪.
কম্পোজিশন
আগেও তোমাকে একবার
কিয়ারোস্তামির ফ্রেমে দেখেছি।
তুমি যে জলপাইপাতা কুড়াও,
তা কিয়ারোস্তামির, না কর্ডোভার,
সে নিয়ে ভাবতে হবে।
বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে
তোমার পা ভিজে যায়।
কেন তুমি ফিল্মের প্রকরণ?
রাতের শেষে তোমার প্রিয় পুতুলনাচের ইতিকথা।
সন্ধ্যায় শোনো আন্দালুসীয় নাবিকের গান।
তোমার কিছু সুর আছে।
এরা বিষণ্নতা নিয়ে বলে।
এদের রঙ নীল।
আর গোলাপিরঙা কিছু সুর,
বলে ভালো ভালো কথা।
এরাই ‘দুয়েন্দে’।
৫.
এলোহিও
তোমার নামের মতো সুন্দর কিছু উপমা হঠাৎ ক’রে আসে।
খালি পড়ে থাকা পুরানো বাড়ির আনাচ-কানাচে সাঁটা টিপের মতো
তুমিও মিলিয়ে যাবে?
আমি লোরকা ভালোবাসি।
লোরকার কমলাবাগান, জলপাইবন, কালো ঘোড়া, চিকন চাঁদ… আমার কাছে থাকে।
তোমাকে দিই জিপসী, আর স্প্যানিশ সুর।
মিশতে থেকো ব্যালাডের সাথে।
আলোর বিপরীতে গেলে তোমারও ছায়া পড়ে।
তুমি জানো, ষাঁড়ের লড়াইয়ে দর্শকদের আসনে দু’টো ভাগ থাকে— ‘আলো’ আর ‘ছায়া’।
হিস্পানি শব্দে জিভ জড়িয়ে গেলে ভাবি,
তোমার নামের চেয়ে সুন্দর শব্দ কতকাল শুনিনি!
৬.
সহজ
ঝাঁ ঝাঁ দুপুর।
কান পাতলে হাঁক শোনা যায়— বাদাম বাদাম...
লাল নেইলপলিশের মেয়ে ছাদে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে।
তোমার পায়ের নিচে পুণ্ড্রের নরম মাটি।
বট আর নদীর ধার বেয়ে
একটা দুপুর চলে যেতে চায়...
ভাঁজ ক’রে রাখা স্বরবিতানের পাতা
খুঁজতে খুঁজতে তুমি ঝিমিয়ে পড়েছো।
দু’একটা পাতা পড়ে কোথাও।
ঘুঘু ডাকে আর পঙ্ক খোঁজে।
এখানে রোদ ডোবে।
৭.
(তুমি) সংরক্ষণ পদ্ধতি
তোমার মতো আমার, কিংবা আমার মতো তোমারও দাঁত দিয়ে নখ কাটতে ভালো লাগে।
প্রতি সন্ধ্যায় শীতের সাথে তোমাকেও জড়িয়ে রাখি।
কীভাবে যেন তোমার থেকে পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর ভেসে আসে।
আমরা বসে থাকি, হাঁটি।
চা-চপ, আর সিঙ্গাড়াও খাই।
থেকে থেকে হাত ধরাধরি করি।
কখনও ভাবি, এইবার ইলেক্ট্রিসিটিটা যাক।
বাবলুর চা’র দোকান পেরিয়ে পুরো একটা শীত হুটহাট চ’লে যায়।
আমি বাসায় ফিরি।
দাঁত দিয়ে নখ কাটি। চুল বাঁধি।
আধভাঙা চুল আর ভাঙা নখে বসে থাকো তুমি।
আর জমা থাকে সবগুলো সন্ধ্যার পুনরাবৃত্তি।
সেখানে বোরোলিন আর তুমি লীন।
শুধু এভাবেই প্রিজার্ভ করা যায় তোমাকে।
পুরোপুরি তোমাকে।
৮.
মেইলদূতের বার্তালাপ থেকে
তৃষ্ণার লিপি জুড়ে ঠোঁটের আবাস,
পানপাত্রে ঢেলে দাও প্রেমের উদাস
পরদেশী প্রিয়, হৃদয় তৃষিত,
অশ্রু-উদ্ভাসে জাগে বিরহ-তিয়াস
কাচঘরে দেখি আমি তব মুখাভাস,
মদিরার মতো মেলে সুখের সুবাস
চুমুক নেই, তবু প্রেমের প্রতীক্ষা,
বুকেতে থেকে থেকে বিরহী সুরবাস
প্রেমিক কোথায়, কোথায় সুমন্দভাষ,
কোথায় লুকিয়ে ফ্যালে ঘন নিঃশ্বাস
পানপাত্র কাঁদে, মদিরা-দহন জাগে,
চুমুর নেশায় মাতে উন্মত্ত-অবভাস
ফিরে এসো, প্রিয়,
পরবাসে পুঞ্জিভূত বিষাদ!
পাত্রে পান ক’রে মুছে ফেলি
সেসব বিরুদ্ধবাদ।
৯.
মধ্যযুগীয় অ্যাক্রস্টিক
অপ্রতুল সুরে বাজে অভিসার গীতি
রূপের স্বরূপ ঢেকে যায় বিস্মৃতি
পরিযায়ী পাখি গায় তন্দ্রার ঘোরে
(পতঙ্গ আলো-ঝাড়ে তড়পায়, মরে)।
তোমার কথা ভাবে তপন দুপুর
(ওষ্ঠে জমে প্রেম, মনে ঘূর্ণিসুর)
মানস-পদ্ম তার কোন জলে ভাসে
কে বা জানে কী ব্যথা এই দূর-বাসে!
লিপ্সার রঙ ছুঁয়ে বৃষ্টির টান
খসে পড়া জল গায় একান্ত গান
ছিটকিনি আঁটে ঘরে এলোমেলো গা’য়
(ইতিউতি হাঁটে দ্যাখো ভেজা ভেজা পায়)।
১০.
তলকুঠুরির প্রোজ
গত শীতেই আমার ডেভিডের সাথে দেখা।
জানুয়ারির ১৪।
দেখা হ’তে হ’তে অন্ধকারে একদিন মনে হ’লো,
আঙুল ছোঁয়ালে পাথর-প্রতিমা শরীর হয় কিনা।
রূপকের অন্ধকার, মৃত্তিকা আর মেঘের খাঁজে
চন্দনের তীব্র ঘ্রাণে গলে পড়লো
প্রথম সভ্যতার উন্মাদনা।
তুমি কি বোঝো, জিভে লেখা অক্ষরগুলো?
দেবতা সেসব বোঝে না।
প্রতিমার জড়ত্ব ভেঙে যায়,
আদি মহাসমুদ্রের ঢেউ, এক জলীয় পৃথিবী আমার আঙুলের ডগায় শুধু থাকে।
পৃথিবীর সমস্ত শিল্প যে প্রতিমা ধরে,
পাথরের শীতল গর্ভ থেকে উথলে ওঠা
কিছু মেঘবৎ, মেঘঘন তরল জিভে লেপ্টে
আমি (আমরা) চাই,
সায়নের বাড়িটা যেন বিক্রি না হয়!
0 মন্তব্যসমূহ
অমার্জিত মন্তব্য করে কোনো মন্তব্যকারী আইনী জটিলতায় পড়লে তার দায় সম্পাদকের না৷