New

শ্বেতপত্র

অনিন্দ্য সান্যাল এর দুটি গল্প


অরিগ্যামি

--

এরা সব বন্ধুবান্ধব কাগজ ভাঁজের শিল্প শিখেছে কোথা থেকে। আজ বিকেলে দেখি ব’সে পড়েছে সে'সব নিয়ে। আমার লেখার নতুন প্যাড দেখতে দেখতে চোখের সামনে হালকা হয়ে গেলো। এমনই মগ্ন সব, যে যেখানে পেরেছে ব'সে পড়েছে। একটু গোল ক'রে, লাইনে বা ফাইলে বস, না রে বাবা ওসব কে করে, এ অবস্থায় যে যার নিজের জগৎ।

    উরিই সাবাস! কতো কি তৈরী ক’রে ফেলেছে। দোয়াতকলম, ফুল, পাখি, নৌকো, উড়োজাহাজ...একজন দেখি আবার একটা পিস্তল বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে এক অকালপক্কের মাথায় কি পোকা নড়লো, চারিদিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে বলে, চল আজ আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলি। ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো, সোও ও ও... সাআ আ...দুম...ফটাস...আঃ...ওঃ...এ বুকে হাত দিয়ে পড়ে যাচ্ছে...ও গড়িয়ে যাচ্ছে মেঝেতে এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল... মেঝেতে ঘষে ঘষে দুলিয়ে দুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নৌকো, যুদ্ধজাহাজ। একজন আবার ওপর থেকে টুপটুপ করে পাখি ফেলতে লাগলো, ও আচ্ছা, বুঝেছি, বিষধোঁয়ায় পাখি ম’রে পড়ছে, বাঃ বেশ ভেবেছে তো...আবার মাঝখানে একটা ফুলও তুলে ধরেছিলো এক ছোট্টো মেয়ে...কে একটা উড়োজাহাজ ছুঁড়ে ছিটকে দিলো হাত থেকে সে ফুল...এমনই চুলোচুলি চলতে চলতে সন্ধ্যে হলো। এবার বাড়ি ফেরার সময়। কাল পরীক্ষা। সে জ্ঞান হয়েছে টনটনে। অ্যাই চল চল, কাল আবার হবে। আমি বললাম, হ্যাঁ রে শান্তিস্বাক্ষরটা তো ক’রে যা। আচ্ছা, হ্যাঁ সেটাও তো হয়, বললো সেই অকালপক্ক। দৌড়ে গিয়ে দোয়াতকলম নিয়ে এলো, সময় নেই। ছিঁড়লো আমার প্যাডের আরেকটা পাতা। তা যাক, স্বাক্ষরটা তো হয়ে থাক আপাতত। বাড়ি ফিরলো শিশুর দল।

যাগগে আমার নতুন প্যাডের নতুন নতুন পাতা।

কাল আবার যুদ্ধ খেলবো আমরা,– চিরশিশুর দল।


--




মৃত্তিকা


--


এই এতদিনের সব কথা যদি আপাদমস্তক সত্যি হয়, ধরে নেওয়া যাক, চলন্ত রেলের সামনে দাঁড়াবেন ব’লে রেললাইনের দিকে হেঁটে যাওয়ার কথা ভেবেছেন বারবার, অথবা, যে ক’টা ঘুমের বড়ি ওষুধের বাক্সে আছে একসাথে সব হাতে নিয়ে ব’সে বারবার স্ব-ইচ্ছায় পরপারে পাড়ি দেওয়ার কথা ভেবেছেন। কিচ্ছু ভালো না, কেউ ভালো না। সব্বাই পালটি খেয়ে খেয়ে পর হয়ে গেছে। মনের মতো একটা কাউকে কোথাও পাচ্ছেন না, যে তাঁকে চোখের সামনে ব’সে তোল্লাই মারা গুনগুনা ভজনা শোনাবে সারা দিনরাত।


মৃত্তিকা। মাটির মানুষ। নিজের তেমন দরকারটি না পড়লে দশঘর’ঘেরা জমি তাঁর মোটেই পছন্দের নয় কোনোদিনই। একটা ছোটো এক’ফসলি জমিতেই তাঁর চিরকালীন আমোদআকাঙ্ক্ষা। চাষবাস করবেন। সোনার ফসল গুছিয়ে তুলবেন ঘরে। মানুষের মুখে মুখে যেমন বিজ্ঞাপন ছড়ায় তেমনটা ক’রে ফসল বিকিয়ে আঁটোসাঁটো ভবিষ্য তৈরীর সাধনায় লিপ্ত হবেন। অবশেষে বাকি ভূ-ভারতের কথা ভুলে, তাঁর নাকি কি সব আত্ম-বলিদানের অঙ্গীকার না অহংকার ছিলো সেসবের কথা ভুলে, হাত-পা ছড়িয়ে ঘুরেফিরে বেড়াবেন।


যতই যা যা ইচ্ছে জমে থাকুক তাঁর বটুয়াতে, কর্মফল ফিরে ফিরে আসে, কপালের লিখন কাটাকুটি হয়ে যায়। এর দোষ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে, গলায় দাপানি তুলেও ইচ্ছেগুলো ঘরে তুলতে পারেন না। ঠাকুমা’র ঝুলির গপ্পের রসদ শেষ হয় একদিন। তাঁর সব বোলবোলা ঘুরতে বেরোয় অন্য চক্করে।


ভালো ক’রে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চলে না আজকাল। তাই তাঁর বিহঙ্গ’ডানায় আড়াল করা ধনরত্নের সামান্য অংশভাগ ভার নামিয়ে আলনা, আলমারি, তোষক, প্যাঁটরার অন্দরেখন্দরে লুকিয়ে রাখেন। অথচ, কি ভবিতব্য দ্যাখো, কোথায় কি রেখেছেন হরবখত সব ভুলে যান। আজ আর কাল গুলিয়ে ঘুলঘুলিতে পায়রার ডাক শুনে নীচে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করেন: এই তোরা তো কেউ-না-কেউ থাকিস এখানে, দেখেছিলি কোথায় রেখেছিলাম?


তবু, রূপকথা কথনের নেশা। তার রসায়ন যে রয়ে গেছে মাথার কোনসব গ্রন্থিতে, তাদের বিকিরণে ভাবতে বসেন: মাটির তলায় সেই যে তিনঘড়া মোহর পোঁতা আছে, তার হদিশ তো শুধু তাঁর কাছেই; ঘড়িতে ঢং ঢং হয়, উনি শোনেন মাটির নীচ থেকে যক্ষ গুনতি করছে কোন ঘড়ায় কটা মোহর... দুই চার পঞ্চাশ একশো... শেষের দিকের সংখ্যাগুলো মাথার ভেতর ছুট ছুট ছুট লাগিয়ে কারা সব ফিসফাস শুরু করে। ঘুমের বড়ি রয়ে যায় হাতে, ঘুমিয়ে পড়েন মৃত্তিকা।


ঘুমের মধ্যেকার আর বাইরের সবাই তাঁকে দেখে ভাবে, ওই তো কেমন সুন্দর হাসি লেগে আছে মুখে, চলন্ত রেলগাড়ির জানলায় বসা দু’বেণী বাঁধা কিশোরীর মতন।


এমন হলেই তো ভালো ছিলো, সবসময়ের এত ডামাডোল আর ছিঁচকাঁদুনেপনা সইতে হতো না মানুষগুলোকে।


সে আবার কি কথা! তেমন হয় নাকি? সারাজীবন ওইসব সঙ-রাঙানো সার খেতে খেতে পাকধরা মৃত্তিকা কি অত সরেস থাকে? যাই ফলাতে যায়, কড়া রাসায়নিকের গন্ধ। ঘুম ভাঙলেই আবার ঘর, বাড়ি, আলমারি, প্যাঁটরা, অন্দরখন্দর। কিছু করা হয় না, কোথাও যাওয়া হয় না মৃত্তিকা’র। ভাগ্যিস!


দু-হাত ঝুলিয়ে গা’এলিয়ে বসে থাকেন চেয়ারে, নতুন নতুন আকাশকুসুম চয়ন করেন নিজেই নিজেকে অর্পণ করবেন ব’লে। তারপর কি ক’রে যেন কিসের ভয় লাগে, বোধ’য় দত্যিদানোর মুখ দেখে চেঁচিয়ে ওঠেন: কোথায় গেলি রে! দ্যাখ না, শরীরটা কেমন কাঁপছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ