New

শ্বেতপত্র

মিসিং নিউজ: ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ আপনি কোথায়?

 লেখক: অসীম নন্দন  

'দ্যা ডেইলি স্টার' সূত্রমতে কুমিল্লায় কী ঘটেছিল?

১৩ অক্টোবর সকাল ৭টা নাগাদ একরাম হোসেন(৩০) নামের একজন যুবক ৯৯৯ এ ফোন করে রিপোর্ট করে যে, নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজা মণ্ডপে কোরাআন অবমাননা করা হয়েছে। খবর পেয়ে ঐ এলাকার ওসি ঘটনাস্থলে একাই যান। কিন্তু ততক্ষণে বেশ ভিড় জমে গেছে। সকাল ৭টা থেকে ৭.৩০ এর মাঝের কোনো এক সময়ে ফয়েজ আহমেদ নামের একজন লোক ফেসবুক লাইভে এসে ৫৬ সেকেন্ডের একটা ভিডিও তৈরি করে। সেখানে সে সকল মুসলমানদের জেগে ওঠার কথা বলে। সকাল ৮টা নাগাদ কয়েকজন যুবকের দল ভিডিওটা শেয়ার করার মাধ্যমে ভাইরাল করার চেষ্টা করে। এবং ঘন্টাখানেকের মাঝে সেখানে শত শত মানুষ জমায়েত হয়। এই সময় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইমরান বাচ্চু একটা বাঁশের বেড়া তৈরি করেন। যাতে জনতা মণ্ডপে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর সকাল ১০টা কি সাড়ে ১০টা নাগাদ যখন সিচুয়েশন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন ৪০/৫০ জনের পুলিশবাহিনী সঙ্গে নিয়ে ডেপুটি কমিশনার কামরুল হাসান এবং এসপি ফারুক আহমেদ ঘটনাস্থলে আসেন। ঘটনাস্থল থেকে ৩০০গজ দূরে ঐ এলাকার মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর বাড়ি। অথচ মেয়র সাহেব সকাল ১০টার আগে ঘটনাস্থল নিয়ন্ত্রণ করতে আসতে পারে নাই। ডিসি, এসপি, কাউন্সিলর এবং লোকাল মসজিদের কয়েকজন ইমাম মিলে সিচুয়েশন শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন সেই জনতার দাবি ছিল পূজা বন্ধ করে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার। তারা স্লোগান দিতে শুরু করে। 'বন্ধ বন্ধ পূজা বন্ধ', 'লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে' এরকম স্লোগানে ঘটনাস্থল মুখরিত হয়ে ওঠে। বেলা ১১টা নাগাদ সেই মব পিপল ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করে এবং সাড়ে ১১টার দিকে মণ্ডপ ভাঙচুর শুরু করে। এর কিছুক্ষণের মাঝেই অতিরিক্ত পুলিশফোর্স আনা হয়। পুলিশ ওপেন ফায়ার করে ছত্রভঙ্গ করতে চায়। বিকেল ৪ টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঐখানে পুলিশের সাথে মব পিপলের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া চলে। এর মাঝেই দুপুর ১২টা থেকে ২টার মাঝে কুমিল্লা শহরের বাইরের ১০টা এলাকা থেকে জনতা এসে কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র পূবালী চত্ত্বরে জমায়েত হয়। এবং তারা তিনটা মন্দির ও ১৪টা পূজা মণ্ডপে ভাঙচুর করে। 

এখন প্রশ্ন হলো, এরা কারা? কোত্থেকে এলো এরা? নানুয়ার দিঘির পাড়ের বসবাসকারী মানুষেরা স্বীকারোক্তি দিয়েছে, যারা আক্রমণ করেছে তারা সেই এলাকার বাসিন্দা নয়। মানে শহরের বাইরে থেকে তারা শুধু ভ্যান্ডালিজম করার জন্য ঐ এলাকায় জমায়েত হয়েছে।

পরের প্রশ্ন, ফেসবুক এখানে কী ভীষণ ভূমিকা রেখেছে তা তো চোখে পড়ার মতন নাকি? এখন পর্যন্ত যতগুলো মব এটাক/ ভ্যান্ডালিজমের ঘটনা ঘটেছে প্রত্যেকটার পিছনে ফেসবুকের গুরুতর অবদান রয়েছে। কুচক্রী মহল এই ফেসবুকের যথেষ্ট অপব্যবহার করছে।    

৩য় প্রশ্ন, প্রশাসন কেন এত গাফিলতি করলো? সকাল ৭টা থেকে ১২টা প্রায় ৫ ঘণ্টা সময়। এই ৫ ঘণ্টায় কি তারা শহরে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারতো না? সিদ্ধান্ত গ্রহণে এত দ্বিধা কেন? এছাড়া ৩০০গজ দূরে থেকেও এমন স্পর্শকাতর ঘটনায় মেয়রের আসতে দেরি হলো কেন? 

৪র্থ প্রশ্ন, সকাল ৭টায় একরাম হোসেন এবং ফয়েজ আহমেদ পূজামণ্ডপে কী কাজে গিয়েছিল? এত সকালে তো হিন্দুরাও প্রার্থণা করতে মন্দিরে যায় না। খুব কম সংখ্যক হিন্দু আছে যারা ভোর সকালে প্রার্থণা করে। আর পূজার একটা নির্দিষ্ট পঞ্জিকামাফিক সময় থাকে, সেই সময়েই পূজা হয়ে থাকে এবং প্রার্থণা করা হয়ে থাকে। তাহলে সেই দুই লোক কেন গেল? তারা কীভাবে জানলো কোরআন অবমাননার জন্য ঐ মণ্ডপে গণেশের কোলে কোরাআন রাখা হয়েছে?

৫ম প্রশ্ন। পূজামণ্ডপগুলা সাধারণত লেট নাইট পর্যন্ত ওপেন থাকে। এবং ভোর-সকালে বন্ধই থাকে। কারণ আরতি এবং প্রতিমাদর্শন লেট নাইট পর্যন্তই চলে। তবে কোরান শরিফ ঐ মণ্ডপে কে বা কারা আনলো? কে বা কারা রাখলো? কোনো হিন্দু কি পূজামণ্ডপে নিজের পয়সা খরচ করে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে এমন কাজ করবে? তাহলে এই বিশাল মাস্টার মাইন্ডের পেছনে কার বা কাদের হাত আছে? ঘটনার বিবরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে এটা হঠাত ঘটা কোনো ঘটনা নয়। পুরা আঁটঘাট বেঁধেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। 

এই প্রশ্নগুলার উত্তর জানা গেলেই ঘটনা খোলাসা হবে। কুচক্রী মহল চোখের সামনে আসবে। সারাদেশে এখনও ধরপাকড় চলছে। ঘটনার শুরুতে যে দুইজন ব্যক্তি একরাম আর ফয়েজ ছিল তাদের পুলিশী হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়েছে। দেখা যাক কতদূর যায় আমাদের প্রশাসন।

২০ অক্টোবরের 'প্রথম আলো'র সূত্রমতে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ইকবাল হোসেন(৩৫) নামের একজনকে চিহ্নিত করা গেছে। এই ইকবালই কোরআন শরিফ কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড় পূজা মণ্ডপে রেখেছিল। তাকে পুলিশ ধরার চেষ্টা করছে। ইকবালকে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এই কর্মকান্ডের মোটিভ বের করতে হবে। এবং এর পেছনে আরো কারা কারা জড়িত তা অনুসন্ধান করতে হবে। প্রশাসনের সেই সময়কার কর্ম-উদ্যোগও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।    

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা দেখে আমি হতাশ। এই হতাশ শব্দটা যদিও খুবই লেইম অর্থপ্রকাশ করে। মানে এই 'হতাশ' শব্দে মনের সার্বিক অবস্থা এবং উদ্বেগ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় না আরকি। আওয়ামীলীগ সরকার কথা দিয়েছিল। কী কথা দিয়েছিল? সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা নামের একটা স্বপ্নের কথা বলেছিল। কিন্তু স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নের থেকেও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। 

'দ্যা ডেইলি স্টার' পত্রিকার সূত্রমতে শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৮০টি মন্দিরে ভাঙচুর হয়েছে। প্রায় ৫ জনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গেছে। ১৩ অক্টোবর থেকেই কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জেলায় মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সঠিক ফিগার আসলে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া লুন্ঠন এবং ধর্ষণের মতন ঘটনার কোনো সঠিক স্ট্যাট সরকারপক্ষ থেকে দেয়া হয় নাই। এমনকি দেশের মেইনস্ট্রিমের টিভি চ্যানেলগুলা পর্যন্ত বোবা ভূমিকা পালন করছে।  

টিভি চ্যানেলগুলা চুপ কেন? সকলেই আদতে বিটিভি হয়ে গেছে। কেবল কৃষি উন্নয়ন এবং উন্নয়নের জোয়ার দেখানো ছাড়া তাহাদের তেমন কোনো কাজ কারবার নাই। বাড়তি যে কাজটা আছে তা হলো, টি-২০ ওয়ার্ল্ডকাপে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা বিষয়ক সংগীত সাধনা করা। প্রত্যেক চ্যানেলে সেন্সরশীপে খবর বের হচ্ছে। টিভিতে কোনো প্রোটেস্টের নিউজও বের হয় না। নোয়াখালীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মানুষ প্রোটেস্টে নেমেছে, শাহবাগে মানববন্ধন করেছে, টাংগাইলে মানববন্ধন করেছে। এইসব খবরও প্রথম অবস্থায় গিলে ফেলেছে টিভি-চ্যানেলগুলা। এবং চ্যানেলগুলা সহিংসতা'র খবর সেন্সর করে অনেক পরে প্রচারিত করেছে।               

মন্দিরে কোরআন থাকা কি খুব বড় অন্যায়? একটা নির্দিষ্ট ধর্মের প্রার্থণালয়ে অন্য একটা ধর্মের ধর্মগ্রন্থ থাকলে কি বিশ্বচরাচরে কেয়ামত নেমে আসবে? এইটাকে আমি তেমন কোনো বড় অন্যায় মনে করি না। আর বাংলাদেশের হিন্দুদের এত বড় বুকের পাটা এখনো হয় নাই যে, হিন্দুরা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার জন্য মন্দিরে কোরআন রাখবে। তাহলে নিশ্চয়ই এইটা কোনো এক কুচক্রী মহলের গভীর ষড়যন্ত্র। রামকৃষ্ণ বলে গেছেন, যত মত তত পথ। যদি হিন্দুর ঘরে বাইবেল থাকে আর মুসলমানের ঘরে থাকে গীতা কিংবা খ্রিস্টানের ঘরে থাকে ত্রিপিটক; তাতে আমি তেমন কোনো বড় অন্যায় তো দেখি না। বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেছিলেন, " ও' কা'রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি'/ ও' মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর ক'রে কেড়ে,/ যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।/ পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!---মূর্খরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ;----গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!"  

জামালপুর-৪ আসন থেকে জনৈক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান সাহেবের কথায় যদিও কিছুটা আশার সন্ধান পাওয়া গেছে তবু মনে সেই কিন্তুটা থেকেই যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও আশ্বাস দিয়েছেন। বিচার নাকি হবেই। আমরাও বিচার চাই। কিন্তু বিচারহীনতার পুরানো ইতিহাস আমাদেরকে স্বস্তি তো দেয় না। ব্লগারহত্যার সবগুলো বিচার কি সম্পন্ন হয়েছে? রামুতে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল তার বিচার? কিংবা শুধুমাত্র কঠোর বিচারের আওতায় আনলেই কি এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব? আমাদের আরো সতর্কতার সাথে এই ব্যাপারগুলা সম্পর্কে ভাবতে হবে। যখন ব্লগারদেরকে হত্যা করা হয়েছিল তখন দেশের অধিকাংশ ধার্মিক মানুষ(তা সে যে ধর্মেরই হোক) চুপ ছিল। কেননা ব্লগাররা নাস্তিক ট্যাগধারী ছিলেন। এবং নাস্তিকতা মতাদর্শের ধুয়া তুলে সেই হত্যাকে নিরব সমর্থন দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সমর্থন দেয়া হয়েওছিলো। একটু একটু করে ঠিক এইভাবেই এই ধর্মান্ধ কুচক্রী মহলকে শক্তির যোগান দেয়া হয়েছে। মাদরাসাশিক্ষাকে আরো বিস্তৃত করা হয়েছে নানান সুযোগসুবিধা দিয়ে। কিন্তু তাদের উপর সেরকম অর্থে কোনো নজরদারির ব্যবস্থাই রাখা হয় নাই। মুরাদ সাহেব বলেছেন, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম মুছে দেবে। তিনি যদি সত্যিই পার্লামেন্টে এটা পাস করতে পারেন এবং আদালত যদি সঠিক রায় দেয়, তবে একটা কাজের মতন কাজ হবে। কিন্তু এই বক্তব্য প্রকাশের পরই তো ধর্মান্ধ মুসুল্লিরা বায়তুল মোকাররমে জমায়েত হয়ে মুরাদ সাহেবের বিচার চাচ্ছে। কোরআন অবমাননার বিচারও তারা চাচ্ছে। মানে সবাই এখন নিজ নিজ জায়গা থেকে বিচার চাচ্ছে এবং একে অপরকে দোষারোপ করছে। দোষারোপের খেলা চলছে। আওয়ামীলীগ বিএনপিকে দোষারোপ করছে আর বিএনপি দোষ দিতেছে আওয়ামীলীগকে। হিন্দু মুসলমানকে দোষ দিতেছে আর মুসলমান দোষারোপ করছে হিন্দুকে। 

তো প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বলছিলেন, এরশাদের কারসাজিতে বাংলাদেশের সংবিধানে পুশ করা রাষ্ট্রধর্ম-ইসলাম টার্মটা তুলে দেয়া হবে। এই কথাটার আসল অর্থ মূলত কী? এই কথার অর্থ হইলো রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্ম হলো মানুষের চর্চিত বিষয়। এইটা রাষ্ট্রীয় সংবিধানে চর্চার বিষয় না। রাষ্ট্রধর্ম না থাকা মানে ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র; সেই রাষ্ট্রে সকল মতাদর্শের মানুষই প্রথম শ্রেণির নাগরিক হবে। একটা রাষ্ট্রের সংবিধানে যখন কোনো পার্টিকুলার ধর্মকে প্রায়োরিটি দেয়া হয়, তখন সেই ধর্মের অনুসারী নাগরিকগণ ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেনশীপ পেয়ে যায়। আর বাকী মতাদর্শের নাগরিকগণ এমনিতেই তখন সেকেন্ড ক্লাস/থার্ড ক্লাস পায়। সেকুলার/ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু ধর্মহীনতা নয়, আমি বারবার এই ব্যাপারটা রিপিট করছি। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সকল মতাদর্শের অধিকার সমান। আমি আবারো বলছি ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা/নাস্তিকতা নয়। আমাদের দেশের বাহাত্তরের সংবিধানে চারটি মূলস্তম্ভের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল অন্যতম একটি। 

কিন্তু ডা. মুরাদ সাহেবের বক্তব্যকে মিসগাইড করা হইতেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনি মুরাদ সাহেবের বলা ধর্মনিরপেক্ষতা টার্মটাকে মিসগাইড করেছেন। তিনি জামায়েত ইসলামের আলেমদের মতন সুর করে বলছেন, কোনো মুসলমান নাকি এরকম ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি করতে পারে না। তিনি বলছেন, মুরাদ সাহেব নাকি শুধু নামে মুসলমান কাজে অন্যকিছু। সাঈদ সাহেবের এলিগেশন মেনে নিলে কিছু প্রশ্ন আপনাআপনি উদয় হয়। ৭২'র সংবিধান প্রণেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কি মুসলিম ছিলেন না? কিংবা সেই সময় সংবিধান প্রণয়নকারী কেবিনেট সদস্যরা কি মুসলিম ছিলেন না? সংবিধানের রচয়িতা কি মুসলিম ছিলেন না? সাঈদ সাহেব আসলে কাদের মন যোগানোর চেষ্টা করছেন? তিনি কি অশিক্ষিত? সাঈদ খোকন এখন এমনিতেই দূর্নীতি-মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দলে নিজের গুরুত্ব হারিয়েছেন। তবে আমার কথা হলো, খোকন সাহেবের মতন আওয়ামীলীগের নেতাও যদি ৭২'র সংবিধান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না রাখেন এবং মিসগাইড করেন তাহলে এখানে নতুন করে ভাবনার অনেককিছু আছে। আওয়ামীলীগের উচিত দলের কর্মী নির্বাচনে আরো সতর্ক হওয়া। আওয়ামীলীগের উচিত ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, জাতীয় চার নেতা, বঙ্গবন্ধু, কলোনিয়াল পলিটিক্স এই সকল কিছু সম্পর্কে শিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিকে কর্মী হিসেবে নির্বাচন করা। আর যদি খোকনের মতন কর্মীসংখ্যা বেড়েই চলে তবে আসন্ন মহামারী ঠেকানো অসম্ভব হয়ে যাবে।

এখন মন চাইতেছে একটা মিসিং ডাইরি মানে জিডি করি আরকি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হারিয়ে গেছে। এবং এই পথভ্রষ্ট অবস্থায় তাকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? আমাদের প্রশাসনিক লোকজন যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হদিস দিতে পারে তাহলে তো ভালো। আর যদি না দিতে পারে? অতীতের কথা বলে তো লাভ নাই। অতীতে আমরা সবাই একসাথে উৎসব পালন করতাম। ঈদ-পূজা-পহেলাবৈশাখে একসাথে আনন্দ করতাম। যা করেছি তা তো অতীতের স্মৃতি। বর্তমানে কী ঘটছে? বর্তমানটাই তো এখন বাস্তবতা। সংখ্যালঘুরা এখন আতঙ্কে থাকছে। আতঙ্কের জন্ম কীভাবে হলো তা তো আর বিশদ বর্ণণার দরকার নাই। ২৯.৭% থেকে হিন্দু নাগরিকসংখ্যা ১০% তে নেমে এসেছে। অন্যান্য ধর্মের মানুষের পরিসংখ্যান আর নাই দিলাম। কেন কমে এসেছে? এই প্রশ্নের জবাব তো খুঁজে বের করতে হবে। ভোটের রাজনীতিতে কি এই পরিসংখ্যান কোনো বিশেষ ইঙ্গিত দিতেছে?                    

আমার বাড়ির সামনেই এই এলাকার কেন্দ্রীয় মসজিদ। মসজিদ থেকে ৫ বেলা আযান হয়। বড় বড় মাইকে বেধড়ক আওয়াজে আযান হয়। আমরা শুনি। কোনো কথা তো বলি না। কখনো তো বলি না মাইগ্রেনের ব্যথা হয়। কখনো তো বলি না অনুভূতিতে আঘাত লাগে। অভিযোগও করি না। এই ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখেন তো? আমার জায়গায় আপনাকে কল্পনা করেন। মাইকে আযানের পরিবর্তে কোনো হার্ড মেটাল গান কল্পনা করেন। এবং কল্পনা করুন আমি দিনে ৩/৪ বার বিকট আওয়াজে হার্ড মেটাল বাজাইতেছি। আপনি কি সহ্য করবেন? সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমারই মাইর খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের দেশের মানুষগুলার কমন সেন্স নাই। পূজায় এরা বিকট আওয়াজে হাই-বিটে গান চালিয়ে শব্দ দূষণ করে। হাসপাতালের সামনে মাইক বাজিয়ে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করে। শব্দ দূষণের তোয়াক্কাই করে না।

কুমিল্লা থেকে যে ঘটনার সূত্রপাত হলো এবং তার কারণে সারাদেশে এই যে মন্দির-ভাঙা, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট হলো; এর দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে। এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। সরকারের ব্যর্থতা এখানে স্পষ্ট।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অন্যতম কারণ হলো আমাদের অপুষ্ট সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। বলা যেতে পারে, বর্তমান বাঙালির চেয়ে অতীতের বাঙালিরা অনেক বেশি সাংস্কৃতিক মননের অধিকারী ছিলেন। সেসময় গ্রামে গ্রামে বাউলগানের আসর বসতো। পুঁথিপাঠ, নৌকাবাইচ, রথের মেলা, যাত্রাপালা হতো। মানুষজন বই পড়তো। তাঁরা বাঙালির সংস্কৃতিকে ধারণ করতেন। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ বাঙালি সংস্কৃতিকে মোটা দাগে হিন্দুয়ানী মনে করে। যে কারণে পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবকে ভিনদেশী সংস্কৃতি বলে অপবাদ দেয়া হয়। মঙ্গল-শোভাযাত্রাকে বলা হয় শিরক। অথচ যারা এই অপবাদ দেয় তারা নিজেরা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, আরব দেশের ফ্যাশন সংস্কৃতিকে নিজস্ব সংস্কৃতি বলে দাবি করে। মানে সেই ১৯৭১ এর রাজাকার আর পাকি-প্রীতি তাদের রক্তে এখনও রয়ে গেছে। তাদের মাঝে সেই ৭১'র শয়তানদের প্রেতাত্মা। তারা দেশকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। শুধু আইন প্রণয়ন করে এই বিপদ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।  সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মানুষের মনোজগতকে জাগিয়ে তুলতে হবে। গ্রামে-গ্রামে, মহল্লায়-মহল্লায় লাইব্রেরি গড়ে তুলতে হবে। খেলার মাঠের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শহরাঞ্চলগুলা যেভাবে অপরিকল্পিত দালানকোঠায় ভরে যাচ্ছে, যেভাবে খেলার মাঠের সংকট প্রকট হচ্ছে তাতে আগামীদিনগুলা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠবে। এজন্য চাই লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, কালচারাল ক্লাব, থিয়েটার।        

কত কত যুগ আগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গিয়েছিলেন, "মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।" কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়াতে যারা থাকেন, যারা লালন-দর্শনের অনুসারী কিংবা যারা ফকিরী-মতাদর্শের লোক তাদের উপরেও তো একটা কুচক্রী মহল নানাভাবে অত্যাচার চালিয়ে যাইতেছে। তাদের কথাও আমাদের ভাবতে। এদেশ তো সুফী-সাধক/বাউলের দেশ নাকি!     
লালন বলে গেছেন:
"গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়।
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রম তো গেল না।।"
আমাদের তো এই কথাগুলো ভুলে গেলে চলবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ