New

শ্বেতপত্র

গল্প: খোলা চিঠি | সপ্তমী দাস


আচ্ছা, আমি কী তোমার কাছে খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম? চাইনিতো। আমি শুধু একবার ঐ কথাটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম। এই চাওয়াটাই কি আমার অপরাধ ছিল? তুমি আমায় তোমার  জীবনে যে অধিকার দিয়েছিলে, সেই অধিকার থেকেই চেয়েছিলাম। তুমি আমায় সেদিন এই বলে বুঝিয়েছিলে, জীবন তো অনেক বড়।এখনো আমাদের একসাথে আরো অনেকটা পথ চলতে হবে। তাই এই ছোটখাটো বিষয়কে এত গুরুত্ব দিয়ে যেন না দেখি। তর্ক করার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র ছিলো না। কেবল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে সমস্ত অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে বের হয়ে এসেছিল। আমি সেদিন তোমার সেই কথাগুলো মেনে নিয়ে চলে এসেছিলাম। আমি আর এটা নিয়ে তোমার কাছে কখনো কোন অভিযোগ করিনি। কথাটা ছিল হয়তো খুব সামান্য। কিন্তু তার মাহাত্ম্য ছিল অনেক বড়।

তোমাকে অনেকবার ভুলে যেয়েও ভালো থাকতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিই যে আমার ভালো না থাকার প্রধান কারণ, সেটি বুঝতে পেরেছি জীবনের প্রতিটি ক্ষণে।

তুমি সবসময় তোমার দিকটাকেই  বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে এসেছ। তোমার কাছে আমার অনুভূতির কখনো কোনো মূল্য ছিল না। আমার তখন নিজেকে খুব তুচ্ছ বলে মনে হতো। যাকে কেন্দ্র করে আমার জীবনের বলয় ঘুরপাক খাচ্ছে, আমার পরিবারের পরের আসনটিতেই যাকে‌ স্থান দিয়েছিলাম, যাকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম, যাকে আমি খুঁটির মতো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম, তার ফলস্বরূপ কী এটাই আমার প্রাপ্য ছিল কিনা জানা নেই।

একটা পর্যায়ে এসে আমার মনে হলো, আমাদের এই আট বছরের সম্পর্কটা শুধুমাত্র একটা কর্তব্যের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ছিলো। যেখানে না ছিল কোন আশা-আকাঙ্ক্ষা, না ছিল কোন সম্মানবোধ, না ছিল কোন ভালোবাসা।

আমি তোমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসতে চেয়েছিলাম,কিন্তু হয়তো  এসে পড়েছিলাম অভিশাপ হয়ে।

আমি সবসময়ই একটি কথা জানতে চাইতাম তোমার কাছে।আসলে তুমি তখন কি চেয়েছিলে?আদৌ কি তুমি আমায় চেয়েছিলে কখনো! আমি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি নিজের কাছে।

হয়তো না বুঝে বোকার মত সেই ঠুনকো পাখির বাসাকে সমস্ত রকমের ঝড়-ঝঞ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে আগলে রাখতে চাইতাম ক্ষীণ আশায়। হ্যাঁ, লোভীই ছিলাম বৈকি। কিন্তু সে লোভ কোন লুকিয়ে রাখা তালাবদ্ধ সিন্দুকের জন্য ছিল না, আমি তোমায় পাওয়ার আশায় কাতর ছিলাম। কিন্তু আমাদের বাঁধন  এতটাই আলগা ছিলো যে সামান্য হাওয়ার দুলুনিতে তা অচিরেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে তা বুঝতেই পারিনি কোনদিন।

দু'ধারের গাল বেয়ে অঝোরে নোনা জলের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'বর্ষাযাপন' কবিতার লাইনগুলি এখন বেশ মনে পড়ছে—
'ছোট প্রাণ, ছোট ব্যাথা, ছোট ছোট দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব,নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইলো না শেষ।'

তিনি তাঁর অসামান্য কবিপ্রতিভার দ্বারা এই সহজ ভাষাগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন।
আমি সেই তুমিকে চেয়েছিলাম, যার সাথে ভালোবাসার অথৈ সমুদ্রে ঢেউয়ের সাথে মিশে যাব। আমরা অনন্ত নীল মুক্ত আকাশে ভেসে বেড়াব পাখিদের সাথে, পাখিদের কলতান শুনবো।

হও না তুমি আমার জন্য একজন কবি, যে তার ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করবে। যে কোনো বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। যার দৃষ্টি হবে আকাশের মত অসীম, যার তেজ ঠিকরে পড়বে যেন সেই তেজোদীপ্ত সূর্যরশ্মির কিরণ। এমন একজন মানুষকেই তো আমি মনে মনে পূজো করে এসেছি। আমার আকুলতা কোথায়, আমি কী পাওয়ার আশায় এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম, বোঝো নি তুমি?

হায়! অদৃষ্ট। এতোদিনে আমায় তুমি এই চিনেছিলে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

অমার্জিত মন্তব্য করে কোনো মন্তব্যকারী আইনী জটিলতায় পড়লে তার দায় সম্পাদকের না৷