New

শ্বেতপত্র

অনুবাদ গল্প: রুম নং ১৪ | মূলঃ মিলকা বানজেভাক-গুজোভিচ | অনুবাদঃ সাজেদুল ইসলাম


ছোট নদীটার ধারে, গাছ-গাছালির আড়ালে, যে বাড়িগুলো ছিলো। পপলার গাছে ঘেরা আমাদের গল্পের এই বাড়িটি সেগুলোর মধ্যে একটি। পূর্বে কোন এক সময় এটার নাম ছিলো এজবার্গ ভিলা। যেদিন তারা অ্যালেনকাকে সেখানে নিয়ে এসেছিলো, নদীটায় তখন বরফ জমে গেছে আর গাছগুলো পাতার আবরণ হারিয়ে একদম টাকমাথা হয়ে পড়েছে। তারা এসেছিলো একটা বড় গাড়িতে করে। যুদ্ধে তার বাবা-মাকে হারিয়েছিলো মেয়েটা। যে লোকটা অ্যালেনকার সাথে এসেছিলেন, কোনো সরকারি কর্মচারী হবেন, লোকটা সদর দরজার উপর লাগানো সাইন বোর্ডটা পড়েছিলেন 'চিলড্রেন্স হোম'। 

এক চোখে চশমার কাঁচ আটকানো একটা লোক তার নাম খাতায় লিখেছিলো- অ্যালেনকা এস্টোইক। যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প কিছুদিন পরের ঘটনা এটা। একচোখে চশমার কাচ আটকানো লোকটা অ্যালেনকার দিকে একটু-আধটু তাকিয়ে তাকে পরখ করতে করতে বলেছিলো- তোমার যা যা চাই সব এখানে পাবে আর জায়গাটা তোমার বাড়ির মতোই মনে হবে। এছাড়া অন্য কোনো চিন্তা কখনোই মাথায় এনো না। তুমি নিজের জন্য বই পাবে, ব্যাগ পাবে, তোমার খাবার একটা ব্যবস্থা হবে, নিয়মিত আর পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা। আর হ্যাঁ, এগারো নাম্বার ডরমেটোরিতে তুমি ঘুমাবে। মাসে একবার তোমার ডিউটি থাকবে- তোমাকে টেবিল-চেয়ার সাজাতে হবে আর রুটির টুকরাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। এখানে প্রত্যেকের সবকিছু নির্ধারিত। স্টাফে কে আছে, কাউন্সিলে কে আছে আর বিগ্রেডে কে এগুলো তুমি জানবে। অর্থাৎ হোমে যা-যা হয় আর কি। তুমি থাকবে ৩নং বিগ্রেড 'এস' এর সাথে। শোনো মেয়ে তুমি বড়দের মান্য করতে শিখবে, স্যামোলিনা খেতে শিখবে আরো শিখবে কীভাবে আলুর খোসা ছাড়াতে হয়। নিজের বিছানা নিজেই করতে শিখবে আর লোকালয় থেকে দূরে, এই নিভৃতে পুরোপুরি মিশে যাবে। এখানকার সমস্ত ছেলেমেয়ে তাই করে।

মনে রেখ সার্বিয়ার মধ্যে এটাই সব থেকে সেরা চিলডেন্স হোম। এই মুহূর্তে গোটা স্কুলে শুধুমাত্র ড্রইং এর ক্ষেত্রেই একটু সমস্যা রয়েছে। আর মিলান প্যাকিচ দ্রুতই এটার উন্নতি করতে যাচ্ছে। আমরা সবাই এটার উপর নজর রাখছি। মেয়েটার সাথে যারা এসেছিলো এরপর তারা চলে গিয়েছিলো। অ্যালেনকা এস্টোইক, এখন থেকে নিজের সমস্ত দায়িত্ব তার নিজের কাঁধে। ক্লাসরুম থেকে ছেলেমেয়েদের কল-কল শব্দ হাওয়ায় ভেসে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ছিলো আর সেই কল-কল শব্দের আবর্তে আটকা পড়ে চোখের জলে ভেসে গিয়েছিলো অ্যালেনকা এস্টোইক। কি করে সে এখন 'এস' ক্লাসে যাবে? আর সবার বন্ধু হয়ে উঠবে? তাকে দেখে যদি কেউ নাক সিটকায়? যদি ঘৃণা করে? সে কি করে এড়িয়ে যাবে এসব? কিন্তু দারিদ্রের কষ্টের চেয়ে কঠোর নিয়মতান্ত্রিক জীবন মেনে নেয়া যে কারো পক্ষে সহজ। এরপর দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর। এক একটা শ্রীহীন বিরক্তিকর নিয়ম মেনে চলার বছর। অসহ্য অবসন্নতা, পড়াশুনা, কান্না আর আনন্দহীনতার বছর। অ্যালেনকা শিখে গেলো কীভাবে স্যামোলিনা গিলে ফেলতে হয়, এমনকি কোনো কোনো সকালে যখন পেট উল্টে বমি বেরিয়ে আসতে চাইতো তখনো। শিখে গেল একটা সৈন্যের মতো নিজের বিছানা নিজেই করে নিতে। আর বাইরের সবকিছু ভুলে নিজেকে পুরোপুরি এই ব্যবস্থার সাথে মিশিয়ে ফেলতে।

কুক অ্যালেনকাকে একটু বেশিই পছন্দ করতো।কারণ সে যত্ন করে আলুর খোসা ছাড়াতো। এক চোখে চশমা পড়া লোকটা তাকে দেখলে সুন্দর করে হাসতো কেননা সে ছিল সেখানকার একজন আদর্শ ছাত্রী। নিয়ম পালনের বাইরে সে আর কিছুই করতো না। অনেক আগেই অ্যালেনকা তার বিগত জীবনের ছায়া মন থেকে সরিয়ে ফেলেছিলো।হোমের সকল ছেলেমেয়ে খেলাধুলা করতো, গান গাইতো। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে যেকোন কাজের পূর্বে ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে তাল মিলিয়ে ভজনগীত গাইতো- 
   "তোমার জন্য স্বদেশ ভূমি আমরা আগুয়ান/                     তোমার জন্য টিটো আমরা আগুয়ান।"

বস্তুত তাদের একজনের সাথে আর একজনের কোনো তফাৎ ছিলো না। যদিও তাদের সবার একটা করে আলাদা নাম ছিলো।

প্রত্যেক বছর অ্যালেনকা একটা করে পুরস্কার পেয়েছিলো। একটা টুথব্রাস, একটা ব্যাগ অথবা একটা বই। পুরস্কারগুলো ছিলো এরকমই অকিঞ্চিতকর কিছু একটা। শ্রমনিষ্ঠা আর প্রাপ্ত নাম্বারের উপর ভিত্তি করে এই পুরস্কার সামগ্রী দেয়া হতো। সহজে ভালো করা অথবা নাম্বার পাওয়ার উপায় হলো, ঐ এক চোখে চশমা পড়া লোকটাকে খুশি রাখা। 

কিন্তু একদিন একটা ঘটনা ঘটলো; অ্যালেনকা এস্টোইকের বয়স তখন চৌদ্দ। কি মনে করে অ্যালেনকা ১৪নং রুমের দরজাটা খুলেছিলো। আর চোখের সামনে দেখলো যোভান! ছেলেটা ভেরোচিকাকে চুমু দিচ্ছে! এর আগে সে তার জীবনে এমন ঘটনা চোখে দেখেনি আর এই ১৪নং রুম সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা ছিলো না। সে কখনো চিন্তাও করেনি এরকম একটা ব্যাপার এখানে ঘাপটি মেরে ছিলো। লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে সে পালিয়ে গিয়েছিলো। ঠিক কী কারণে, সে বুঝতে পারেনি। সে জানতো না কেন সে অমনটা করেছিলো। এরপরও কি রুমটাতে এরকম কিছু ঘটে যাচ্ছিলো? তখন পর্যন্ত ছেলেদের সম্পর্কে অ্যালেনকার সোজাসাপটা রকম একটা ধারণা ছিলো। ছেলেরা পাখির বাসা পাড়তে ওস্তাদ, মার্বেল এবং চাকতি খেলায় খুব দক্ষ আর চেরিফল চুরি করতে তাদের জুড়ি নেই যেন চকিতে সব ঘটে গিয়েছিলো। অ্যালেনকার তখন বাঁধ ভাঙ্গা বিস্ময়। ফলত  সারাক্ষণ তার কানে বাজতে থাকলো একটা গুনগুন, একটা ফিসফিস- যোভান ভেরোচিকাকে চুমু দিচ্ছে, রুম নং ১৪, রুজিকাকে চুমু দিচ্ছে মিলান; অনেকটা এরকম। ১৪ নং রুমটা ছিলো উপর তলায়, পুরোপুরি চোখের আড়ালে। কোনো একটা মন্দ কাজের জন্য যেসব ছেলেমেয়েদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো তাদের জন্য এটা ছিলো একটা নিকৃষ্ট স্থান। এটা হলো সেই জায়গা কেউ ড্রইং-এ খারাপ করলে প্যাকিচ বার্চশাখার চাবুক দিয়ে তাকে পেটানোর পর যেখানে পাঠাতো। আর যারা বেঞ্চ ভাঙ্গতো কিংবা ফলমূল চুরি করতো অথবা পৃথিবীর আর সব কিছু ভুলে নিয়মতান্ত্রিক এই জীবনে নিজেকে কবর দিতে ব্যর্থ হতো, তারা ছিলো এই রুমের নিয়মিত অতিথি।

এমনি করে এটা ছিলো সব রকম কুকীর্তির রুম। এই প্রথম অ্যালেনকা উৎসাহ আর উত্তেজনা নিয়ে ১৪ নং রুমের দিকে তাকিয়েছিলো। এটা হয়ে উঠেছিলো একটা রহস্যের আধার। তুমি বার্চশাখার পিটুনি পেতে পার অধিকন্তু চুমুও পেতে পার তুমি সেখানে। হোমে আসার পর সেই প্রথম অ্যালেনকা তার রুম গুছিয়ে রাখতে ভুলে গিয়েছিলো। সে কেবলি ভেবেই যাচ্ছিল ১৪ নং রুমের কথা। আর শীঘ্রই বার্চশাখার পিটুনি সমেত তাকে ১৪ নং রুমে পুরস্কৃত করা হয়েছিলো। এবার সে রুমটাকে ভিতর দিক থেকে ভালোভাবে দেখেছিলো। এরপর অ্যালেনকা একদিন চুমুর পরশও পেয়েছিলো। সে ঠিক নিশ্চিত নয় এটা কীভাবে ঘটেছিলো। হ্যাঁ ঘটনাটা ঘটেছিলো ১৪ নং রুমে। হোমে আসার পর প্রথম চুমু। এরপর জীবনটা তার কাছে মধুর হয়ে উঠেছিলো। নিয়ম ভঙ্গের ভয় ঝেড়ে ফেলে ছোট্ট সুন্দর অ্যালেনকা ব্রিগেডের বাইরে কোনো কিছুর প্রেমে পড়েছিলো এবং চমৎকার একটা উদাহরণ তৈরী করেছিলো। ছেলেটার নাম ছিলো মার্কো। আর শুধুমাত্র মার্কোই নয় যোভান, মিলান এবং আর সব ছেলেরা যারা ঐ পপলার গাছ ঘেরা বাড়িটায় তার সাথে থাকতো তারাও এমনটাই করেছিলো।

এরপর সেখানে ছিলো এক নতুন অ্যালেনকা, যার চোখে ছিলো স্পৃহা আর নরম ঠোঁটে অদ্ভুত সুন্দর হাসি। রুম নং ১৪ যার হৃদয়ে স্থির হয়ে সেটে আছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

8 মন্তব্যসমূহ

  1. এ তো সেই গল্প! এইটা প্রকাশ দারুণ ব্যাপার হলো৷ আরেকটা আছে না? ঐটাও প্রকাশ করুন৷
    আর সাজু ভাইকে বলুন নতুন অনুবাদের জন্য… ওনাকে কাজে লাগান… ওনার পক্ষে ভালো মানের অনুবাদ সম্ভব৷

    উত্তরমুছুন
  2. সুন্দর অনুবাদ,,.লেখক ও অনুবাদক দুজনই নতুন হলেও ভাললেগছে

    উত্তরমুছুন
  3. মোঃ তাইজুল ইসলামবুধবার, ২৭ জুলাই, ২০২২

    অনুবাদ মানসম্মত না

    উত্তরমুছুন
  4. আরো অনুবাদ গল্প পড়তে চাই

    উত্তরমুছুন
  5. সামেনা সালোয়ারসোমবার, ০১ আগস্ট, ২০২২

    অশ্লীলতার ইঙ্গিতধর্মী গল্প। এসব গল্প প্রকাশ করে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো?

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আমি কোন কিছুই বোঝাতে চাচ্ছি না, যা বলার লেখক বলে দিয়েছে তার গল্পে।

      মুছুন

অমার্জিত মন্তব্য করে কোনো মন্তব্যকারী আইনী জটিলতায় পড়লে তার দায় সম্পাদকের না৷