New

শ্বেতপত্র

একটি শাড়ি কেনার গল্প --- আহম্মেদুল কবির



আর মাত্র ক'দিন পরেই ইদ। সলিমের ইচ্ছা যত কষ্টই হোক এবারের ইদে বউকে একটা নতুন শাড়ি কিনে দিবে সে। গত ইদে একমাত্র মেয়ে মুক্তিকে নতুন জামা- কাপড় দিয়ে সজিয়েছিল সলিম, কিন্তু বউকে কিছুই দেয়া হয়নি তার। তাই এবারের ইদে বউকে নতুন শাড়ি কিনে দেবার ইচ্ছা সলিমের মনে নিয়ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সলিম হিসাব করে ইদের বাকী দিনগুলিতে সংসার চালানো, বউয়ের শাড়ি ও ইদের দিন একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে কমপক্ষে তিন- চার হাজার টাকার প্রয়োজন। সলিম ভাবে কি করে এতো টাকা যোগাড় করা যায়। গত কয়েক দিন বাজার খরচ কমিয়ে প্রায় পাঁচশত টাকা জমিয়েছে সে। বাকী টাকা আর কোন মতেই জোগাড় হচ্ছে না, জমানোও যাচ্ছে না। 

সলিমের চোখে ঘুম নেই। সারা রাত সে কি যেন বিরবির করে হিসাব করে। বউ কাজলি সলিমের বিরবির করে হিসাব করার বিষয়টি লক্ষ্য করে। প্রশ্ন করে কি'গো! সারা রাত অতোসব কি বিরবির করো। সলিম জবাব দেয় কি আর বিরবির করি, আর কদিন পরেই  ইদ হাতে'তো তেমন টাকা- পয়সা নাই, কাজ-কামাইও মাঝে মধ্যে ফাঁক যায়। কাজলি বুঝতে পারে সলিমের বিরবির করার বিষয়। বিছানার দিক ফিরিয়ে কাজলি-সলিমকে কাছে টানে। মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে বলে, জমানো পাঁচশত টাকা দিয়া এবার ইদে যেন তার (স্বামীর) জন্য শার্ট ও লুঙ্গী কিনে। সলিম কাজলির কথা শুনে হাসে! কিছুই বলে না। কাজলি আবার  জানায়, সকালে রাজুভাবী বাড়িতে আইছিল, মুক্তিকে স্যালোয়ার- কামিজ দিবে বলে নিয়া গ্যাছে। রাজু ভাবী বরাবরের মতো এমনি করে। রাজু ভাবীর ভয়! খুশির দিনে গ্রামের কোন শিশু আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলে তাতে নাকি গ্রামের মানুষের অমঙ্গল হয়। এই অন্তর্নিহীত ভয় ও গ্রামের দরিদ্র সলিমের পরিবারের প্রতি ভালোবাসায় রাজুভাবী মুক্তিকে নিয়ে যান প্রতি ইদে। মুক্তিকে নতুন জামা বানিয়ে দিবে শুনে সলিম হাসে। সলিম জানে, ভাবী আসবেন, মুক্তিকে নিয়ে যাবেন, নতুন জামাও বানিয়েও দিবেন।
কিন্তু, স্বামীর কাছে স্ত্রী'র যে প্রত্যাশা যে আশা তা কেমন করে পূরণ করবে সলিম। অনেকক্ষণ চুপচাপ দেখে ফের প্রশ্ন করে কাজলি, কি'গো ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি। সলিম উত্তর দেয় হুঁ! ফের হুঁ! ঘরের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো দেখা যায়।
প্রতিদিনের মতো আজো একটা ছোট্র চটের ব্যাগ ও হাতে দা নিয়ে শহরের দিকে কাজের সন্ধানে হাঁটা শুরু করে সলিম। হাঁটতে - হাঁটতে  ফের হিসাব করে ইদের বাকী দিন গুলি কাজের ফাঁক না গেলে বউকে একটা শাড়ি  কিনে দেয়া যাবে। ইদের দিন ভালো খাওয়া যাবে। নদী পার হয়ে একত্রে  কিছু লোকের ভীড় দেখতে পায় সলিম। এগিয়ে আসে কাছাকাছি। কাছে আসতেই সলিমের এক বন্ধু  তমিজ মিয়া সলিমকে দেখা মাত্র ডাক দেয় সলিম ও সলিম-এই প্যাকে আয়। সলিম এগিয়ে আসে। চেয়ারে বসে থাকা এক - ভদ্রলোককে দেখিয়ে দিয়ে তমিজ বলে, স্যার; উয়ার নাম সলিম। উয়ার গ্রাম থাকি প্রতিদিন পঞ্চাশ-ষাট জন শহরোত কাম কইরবার আইসে, এই প্যাকে হামরা আছি বিশ-পঁচিশ জন। কাইল থাকি কাম শুরু করি দেই, বাকী মানুষ দু'এক দিনের মধ্যে যোগাড় হয়া যাইবে। রাজী হয় ভদ্রলোক। সলিমকে বলে কি-হে সলিম মিয়া আমার অনেক কাজের লোকের দরকার, তোমার গ্রাম থেকে কিছু লোকজনকে যোগাড় করে নিয়ে আসতে পারবা। প্রায় এক বছর কাজ হবে, প্রতিদিন চারশ' করে টাকা পাবে। শুনে সলিম থ'মেরে যায়! জবাব দেয় হ' পারুম, কিন্তু এতো লোক দিয়া কী হইবে, সলিম প্রশ্ন করার আগেই বন্ধু তমিজ মিয়া জানায়, সলিম তোর গ্রাম থাকি রহিম মিয়া, আইজার ভাইদের নিয়া পঞ্চাশ-ষাট জন যা পারিস কাইল সকালে নিয়া আসিস। সলিম বন্ধু তমিজকে প্রশ্ন করে অতো মানুষ দিয়া কি হইবে। অতো মানুষ কি কাম কইরবে। তমিজ জানায়, হামার সোনাহাটোত বলে ইপিজেট কি-জানি, কি হইবে। অটায় বলে বড় বড় আস্তা, বড় বড় বিল্ডিং বানাইবে। ঐ ভদ্রলোক সরকার থাকি কাম নিছে, মেলা কামের মাইনষ্যের দরকার। কাইল বিয়ান থাকি ঘাটের মধ্যে ট্রাকে-ট্রাকে ইট, পাথর আইসপে। হামরা খালি উবামো, তুই না করিস ন্যা। সলিম রাজী হয়। ভদ্রলোক সলিমের নাম লিষ্ট করে উপস্থিত সকলকে এক'শ করে টাকা বকসিস দিয়ে সকলকে সকাল-সকাল কাজে যোগ দিতে বলে চলে যায়। উপস্থিত সকলে আগামী কাল কে-কীভাবে কাজ শুরু করবে বুদ্ধি পরামর্শ করে যে যার মতো কাজে চলে যায়।
একশত টাকা পকেটে পুরে মনের আনন্দে সলিমও ফের হাটা শুরু করে শহরের দিকে। সলিম শহরে সারাদিন কাজ করে আর ভাবে আগামিকাল থেকে চারশত করে টাকা পাওয়া গেলে ইদ পর্যন্ত তিন- চার হাজার টাকা জমাতে পারবে সে। সলিম মনে-মনে আশ্বস্ত হয়। নিজের প্রতি বিশ্বাস জন্মে এবার ইদে বউকে একটা নতুন শাড়ি কিনে দিতে পারবে সে। সেই সাথে মেয়ে মুক্তিকেও কিছু কিনে দেয়ার চিন্তা করে, স্বপ্ন দেখে, এভাবে এক বছর কাজে ফাঁক না গেলে একটা ধানের জমিও কিনবে। সলিম চায়না ভিজিডি কার্ডের চাল তুলতে গিয়ে কাজলি লাইনে দাঁড়াক, মানুষের গলা ধাক্কা খাক্। সলিম মনে মনে দোয়া পড়ে " হে আল্লাহ অমন ভদ্রলোকদের তুমি তৌফিক দিও ওমরা যেন প্রতি বছর একটা করি ইপিজেট বানায়"। দোয়া পড়তে- পড়তে দু'মাইলের চর, বালুচর, নদীপথ পেরিয়ে বাজার খরচ করে বাড়ি ফেরে সলিম।
বাড়িতে ঢুকেই বউকে ডাক দেয়। কই'গো মুক্তির' মা তারাতাড়ি ভাত'দে।
স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কাজলি বুঝতে পারে বোধ হয় আজকের উপোষ খুব তাড়া দিছে। ভাত দেয়া কাজলি। ভাতের গ্রাস মুখে তুলতেই অভক্তিতে উঁকি মারতে চায় সলিম। খুল্টি কালাইয়ের ডাইল আর আলুভর্তা কত খায়, কিন্তু না খেয়ে উপায় কি, কামলা দেয়া টাকায় তো আর গোস্ত কেনা যায়না, যা জোটে সেটাই খাওয়া ভালো।
সলিম তার অভক্তির কথা বউকে বুঝতে দেয় না বরং বউয়ের আলু ভর্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।  প্রশ্ন করে কি'গো মুক্তির' মা শুটকী মাছের গুড়া দিয়া এতো সুন্দর আলু ভর্তা বানাইতে শিখলি কার কাছ থাকি। কাজলি মুচকী হাসে। উত্তর দেয়, ক্যান বুঝেন না আপনের ঐ বাজার খরচের ব্যাগ দেখি। সলিম এবার একটু থেমে যায়। বউকে ফের প্রশ্ন করে, ডাইল আলুভর্তা খাইতে-খাইতে বুঝি বিরক্ত ধরছে। কাজলি রেগে উঠে জবাব দেয়, আমার'তো ধরছে আপনের ধরে নাই। পকেটে'তো দশ- বিশ ট্যাকা ছিল হামার জন্যে না হোক, মাইয়্যোটার জন্যে একটা ডিম আনতে পারতেন। সলিম বলে, আইনমুরে আইনমু, কাইল থাকি তোর জন্যেও আনুইমু। সলিমের অমন কথা শুনে বউ কাজলি এবার যেন আকাশ থেকে পরে। স্বামীকে জিঞ্জেস করে কোন চেরাগ পাইলেন নাকি। গামছায় হাত মুছতে - মুছতে সলিম জানায়, মনে কর অমনে। কাজলি জানার আগ্রহ নিয়ে সলিমের আরো কাছাকাছি হয়। জানতে চায়, স্বামীকে আজ অতো হাসিখুশি লাগছে কেন। সলিম কাজলি'কে জানায় সেই খুশির কথা, আশার কথা। আগামী কাল থেকে একনাগারে বছর খানেক কাজ হবে, তাদের আর দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। বউ কাজলি এবার একটু নীরব হয়। হিসাব করে কাজের ফাঁক যদি না যায় তাহইলে'তো কোন সমিস্যা নাই।

জমানো পাঁচশত আর প্রতিদিন একশ করে টাকা কম খরচ করলে ইদের বাকি দিন গুলিতে কিছু টাকা জমবে, সলিমকে হিসাব শোনায় কাজলি।  কাজলি এবার একটু জোর দিয়ে ইদে সলিমের জন্য একটা শার্ট ও লুঙ্গি কিনতে বলে। কাজলির হিসাব শুনে সলিম হাসে। আকাম্মাৎ কাজলি'কে জড়িয়ে ধরে বলে, কি'গো স্বামীর জন্যে খুব দরদ-নিজের জন্যে কিছু কও!  কাজলি কোন উত্তর দেয় না। বলে উহ!উহ! ছাড়েন মুক্তি আইস্যা পড়বো!

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের জ্যোৎস্নায় সারা গ্রাম ঝলমল করছে। সলিম ঘর থেকে বেড়িয়ে প্রতিদিনের মতো আজও উঠানের আমগাছের নীচে পাতানো টংঙে শুয়ে পড়ে। গুয়া, পান, বালিশ ও একটি কাঁথা নিয়ে কাজলিও আসে পিছে-পিছে। মাদুর বিছানো টংঙে কাথা মোড়া দিয়ে গুয়া, পান চিবাতে থাকে সলিম। স্বামীর পাশে শুয়ে কাজলিও  পান খায়, মাঝে মধ্যে গুনগুন করে গানও গায়। সলিম কান পেতে দেয় বুঝতে চায় সেই গানের ভাষা, বুঝতে পারে না। সুর কাছে টানে, দু'জনে কাছা কাছি হয় আরো কাছে, খুব কাছে। সলিম প্রশ্ন করে কি'গো এবারের ইদে কেমন শাড়ি নিবি নাল না নীল। কাজলি জবাব দেয় চাঁদ উঠে নাই। সলিম বলে ধ্যাত! হিসাবের চাঁদ উঠবোই। বলনা কেমন নিবি? কাজলি এবার চোখ তুলে স্বামীর চোখের দিকে তাঁকায়। মুচকি হেসে জানতে চায় সত্যিই দিবেন, দিয়েন আপনের চোখের মতোন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. শয়তান মুক্ত দিবসের প্রভাতে সুন্দুৱ গল্প৷ জাজাকাল্লা খায়রাহ

    উত্তরমুছুন
  2. এমন যদি আমার স্বামী হত৷ খুব ভাল লাগল কবিসাহেব৷

    উত্তরমুছুন
  3. হৃদয়বিদারক গল্প পরে খুশি হলাম৷ লেখক ও সম্পাদক দুজনই মেধাবী মানুষ বোঝা যায়৷

    উত্তরমুছুন
  4. কবির ভাই সালামালাইকুম। আপনি যে একজন সত্যিকারের উচ্চমানের লেখক, এই গল্প তার প্রমাণ। আপনার আরও গল্প পড়িতে চাই।

    উত্তরমুছুন
  5. গুলতেকিন কোবরা সুলতানাবৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৪

    এরকম মিষ্টি গল্প পড়তে আনন্দ লাগে। বন্ধু তুমি ভাল কাজ করেছো। তোমাকে ইদ মোবারক। আসো কোলাকুলি করি।

    উত্তরমুছুন
  6. ماشاء الله، جزاك الله خيران. أريد أن أقرأ مثل هذه القصص مرارا وتكرارا. لقد كانت جميلة

    উত্তরমুছুন
  7. কি সুন্দর গল্প৷ মারহাবা, মাশাললা

    উত্তরমুছুন

অমার্জিত মন্তব্য কাম্য নয়