New

শ্বেতপত্র

কাঁটালপাড়ার বঙ্কিম অকালে হারান প্রাণপ্রিয়া স্ত্রীকে। খুন হন কন্যা। নিজে বাবার প্রতি অভিমানে ঘর ছাড়েন। এ কোন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? ✍️ অনিরুদ্ধ সরকার





প্রয়াণের বারো বছর না পেরোলে যেন জীবনচরিত লেখা না হয়! এমনই এক নির্দেশ জারি করে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেন?


প্রয়াণের বারো বছর না পেরোলে যেন জীবনচরিত লেখা না হয়!


এমনই এক নির্দেশ জারি করে গিয়েছিলেন তিনি।


কিন্তু কেন?


খুব সম্ভবত তাঁর ধারণা ছিল কোনও ব্যক্তি মারা যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই জীবনী লিখলে সব কথা খোলাখুলি বলা যায় না।


এই বিশ্বাসের কথা তিনি বলেছিলেন বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী লিখতে বসে।


বন্ধুর জীবনের রূপরেখাটুকুও দাঁড় করতে অপেক্ষা করেছিলেন তিন-চার বছর।


তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


অদ্ভুত এক ছেলেবেলা তাঁর। প্রখর স্মৃতিশক্তি। শোনা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার আগে পাঠ্যপুস্তকের খোঁজ পড়ত। এক দিনে এক একটা গোটা বই পড়ে ফেলতে পারতেন!


কাঁটালপাড়ার বাড়ির কাছেই ছিল ওঁর বাবা যাদবচন্দ্রের পাঠশালা। বঙ্কিম অবশ্য পাঠশালায় যেতেন না, গুরুমশাই আসতেন বাড়িতে।


পাঁচ বছর বয়েসে বঙ্কিমের হাতেখড়ি হয় গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকারের কাছে।


গুরুমশাই বুঝেছিলেন, মেধাবী ছাত্র বঙ্কিম যে দ্রুততার সঙ্গে পাঠ নিচ্ছে, তাতে তার কাজ আর বেশি দিন থাকবে ন।


এ’ও শোনা যায়, শিশু বঙ্কিম নাকি একদিনেই আস্ত বর্ণপরিচয় শেষ করে ফেলেছিল!


পড়াশুনোয় ভাল তো বটেই, সঙ্গে আত্মসম্মানবোধও প্রখর।


আসা যাক তেমনই একটি ঘটন়ায়।


যাদবচন্দ্র যখন মেদিনীপুরের ডেপুটি কালেক্টর, বঙ্কিম বছর চার-পাঁচ টানা বাবার কাছে যেতেন, আসতেন।


ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যাদবচন্দ্রের বেশ ঘনিষ্ঠতা। মাঝেমধ্যে সাহেবের বাংলোয় যেতেন তিনি। সঙ্গে যেতেন বঙ্কিমও। সেখানে সমবয়েসিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন বঙ্কিম।


এক দিন ম্যাজিস্ট্রেটের অন্দর থেকে চা-পানের ডাক এল। তাতে গেলেন কেবল সাহেবের ছেলেমেয়েরা। বঙ্কিম বাদ। ঘটনাটি খুব মানে লেগেছিল তাঁর। অপমানে তার পর থেকে আর যাননি সে-বাংলোয়।


মেদিনীপুর থেকে এ বার কাঁটালপাড়ায়।


সে আরেক কাণ্ড!


মাথার ওপর তেমন শক্ত কোনও অভিভাবক নেই। বাবা থাকেন দূরে। মা অতিরিক্ত স্নেহকাতর।


ফলে যা হবার, তাই-ই হল।


বাইরের কোনও খেলাতেই তেমন মন নেই। নেশা ধরল তাস-এ। সঙ্গী জুটিয়ে নেন নিজেই।


ফুরসত পেলেই তাস।


না জানেন সাঁতার, না ঘোড়ায় চড়া। তার মধ্যেই এক উদ্ভট ঘটনা বাধিয়ে বসলেন।


লোক ডেকে কী এক খেয়ালে দাদার সাধের ঘোড়াটাকে দিলেন বেচে!


কী বিচিত্র কৈশোরকাল!


দাদাদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে ধূমপান করতেন ছোট বয়স থেকেই। দাদারাও তেমন, কেউই আপত্তি করতেন না।


বৈঠকখানা ঘরে আড্ডা বসত নিয়ম করে। ওখান থেকেই তামাকু সেবনের শুরু।


আড্ডাতে যে সবাই সাধু গোছের সঙ্গী, মোটেই তা নয়। বরং বখাটে ছেলেপুলে জুটিয়ে নিয়ে আড্ডা দেওয়া ছিল মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রের দস্তুর।


অদ্ভুত, ওই অতটুকু বয়সেও দাদার এই ব্যাপারটি কিন্তু তেমন ভাল মনে নেননি বঙ্কিম!


বঙ্কিম দেখতেন, ধীরে ধীরে উচ্ছন্নে যেতে বসেছে তাঁর দাদাটি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সঞ্জীব পরীক্ষার দিনেও কলেজমুখো না হয়ে দাবা খেলে খেলে দিন কাটিয়েছেন, এমনও হয়েছে।


এ নিয়ে বঙ্কিমের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। রাগের চোটে দাদার এই আড্ডাধারীদের তিনি ডাকতেন ‘বানর সম্প্রদায়’।


••••••


দাদাদের সঙ্গে আড্ডায় বসতেন বটে, কিন্তু এই ভিড়ের বাইরে ছোট থেকেই বঙ্কিমের একটি নিজের জগৎও ছিল।


পড়াশুনোতে ধারালো ছিলেন কলেজেও। ভাল ফল করতেন। বৃত্তিও পেতেন। বৃত্তির টাকায় একটা ছোট বাগান বানিয়েছিলেন।


চাটুজ্জে পরিবারের অনেক পুকুর। তার এক-একটির নাম এক এক রকম— অর্জুনা, ভীমা, ঠাকুরপুকুর, সরের পুকুর।


এগুলোর মধ্যে পদ্মপাতায় ঢাকা পদ্মফুলের শোভায় মোড়া অর্জুনার কদরই ছিল বেশি।


অর্জুনার চার পাশে আমবাগান। দাদা শ্যামাচরণ খুব যত্ন করে গড়ে তুলেছিলেন জায়গাটিকে।


এই অর্জুনার ধারেই একটি ছোট বাগান তৈরি করলেন বঙ্কিম। কলেজের মালিকে ডেকে নানা রকম ফুলের চারা লাগালেন।


অবসর পেলে মাঝে মাঝেই পুকুর ধারের এই ঘাসজমিতে পায়চারি করতেন বঙ্কিম। নয়তো অর্জুনা-বাগানে একাকী বসে থাকতেন। নির্জনতা ছিল এতই প্রিয়!


এক এক সময় নিজেকে নিয়েই থাকতে ভালবাসতেন।


••••••


১৮৫৭-র জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।


তার এক বছর পরেই বিএ পরীক্ষা।


সিলেবাস বেশ কঠিন। পরীক্ষা দিলেন তেরো জন। ডিগ্রি পেলেন মাত্র দু’জন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর যদুনাথ বসু।


তবে ষষ্ঠ পত্রে এঁদেরও পাশ নম্বরে ঘাটতি ছিল। ৭ নম্বর ‘গ্রেস’ দেওয়া হল দু’জনকে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জে ডবলিউ কোলভিল কৃতী ছাত্র দু’জনকে সমাবর্তনে উপস্থিত করলেন বিশেষ পোশাকে। ১৮৫৮-র ১১ ডিসেম্বর শনিবার টাউন হলে সমারোহ করে অনুষ্ঠান হল।


প্রথম গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পেলেন দুই বাঙালি। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ঘটনাটি ফলাও করে লিখলেন। তাঁর গর্বের শেষ নেই। আসলে এই কৃতীদের একজন যে অল্প বয়েসে তাঁর পত্রিকায় কবিতা লিখতেন! যাঁর নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


শুধু ইস্কুল-কলেজের ভাল ছাত্র বলে নয়, পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বঙ্কিম বরাবরই ভাল পড়ুয়া।


ঊনবিংশ শতাব্দীর কলেজ-বইয়ের তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় রাশি রাশি বই তখন ছাত্রদের পড়তে হতো। চসার, স্পেন্সার, শেক্সপিয়র, স্কট, শেলি, বায়রন, মিলটন, টেনিসনের পাশাপাশি কালিদাস, ভারবি, বাণভট্ট...!


বঙ্কিমকেও এ সব পড়তে হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে বাইরের বই পড়াতেই যেন তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি।


নৈহাটির ভাটপাড়ার জয়রাম ন্যায়ভূষণের কাছে বসে বঙ্কিম রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা পড়েছিলেন।


দাদা সঞ্জীবচন্দ্রর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও প্রচুর ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের বই ছিল। সে গুলি আসত সে কালের প্রসিদ্ধ ‘থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে। সে সবের মধ্যেও ছিল বঙ্কিমের নিরন্তর বিচরণ।


কাঁটালপাড়ার দক্ষিণে হাঁটাপথে চার কিলোমিটার গেলেই নারায়ণপুর। সমৃদ্ধ গ্রাম। গ্রামের এক গৃহস্থ-কর্তা নবকুমার চক্রবর্তী। তাঁর পাঁচ বছরের কন্যা মোহিনী। মোহিনী রূপসী। তাঁকে পছন্দ করে ভাই বঙ্কিমের সঙ্গে বিয়ে দিলেন বড়দা শ্যামাচরণ।


বিয়েতে বাপের বাড়ি থেকে মোহিনী পেলেন অনেক গহনা। বঙ্কিমের পিতা যাদবচন্দ্রও পুত্রবধূকে অলঙ্কারে ভরিয়ে দিলেন।


দিন যেতে না যেতেই বালিকা বধূ মোহিনী হয়ে উঠলেন শ্বশুরবাড়ির সকলেরই স্নেহের পাত্রী।


বঙ্কিম তখন কলেজ-পড়ুয়াও নন। বয়স সবে দশ পেরিয়েছেন।


পরীক্ষায় ভাল ফল করে বৃত্তির টাকা ছিল বঙ্কিমের একমাত্র উপার্জন। সেই বৃত্তির টাকায় যেমন বাগান করেছিলেন, তেমন স্ত্রী মোহিনীকে দিতেন নানান উপহার। তার মধ্যে অলঙ্কারও ছিল। দুটি কানের দুল আর সোনার একটি চুলের কাঁটা কিনে দিয়েছিলেন তিনি।


মোহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গোড়ার থেকেই নিবিড়। কিন্তু তা শুধু যে উপহার দেওয়া-নেওয়ার মতো সোহাগে-আহ্লাদে মোড়া ছিল, তা নয়। নতুন কিছু লেখা হলে এই মোহিনীই হতেন বঙ্কিমের প্রথম শ্রোতা। সারাক্ষণ মোহিনীকে যেন চোখে হারাতেন বঙ্কিম।


মোহিনী মাঝে মধ্যে নারায়ণপুরে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতেন। বঙ্কিমের তখন কিছুতেই বাড়িতে মন বসত না।


লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে সোজা চলে যেতেন নারায়ণপুর। শুধু মোহিনীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য। তাঁকে চোখের দেখা দেখতে পাবেন বলে। মাঝে মাঝে রাতও কাটাতেন শ্বশুরালয়ে। ভোরে ফিরে আসতেন কোনও এক সময়।


এই ঘটনাক্রমের বর্ণনা এক জায়গায় পাওয়া যায়—‘‘... (বঙ্কিম) বাড়িতে উপস্থিত হইয়া পড়িতে বসিতেন। সঞ্জীবচন্দ্র বঙ্কিমকে পড়িতে দেখিয়া (রাত্রে) শুইতে যাইতেন। আর ভোরে আসিয়াও পাঠ নিমগ্ন দেখিতেন। আশ্চর্য হইয়া তিনি প্রায়ই জিজ্ঞাসা করিতেন—বঙ্কিম কি সারারাত জেগে পড়েছে?’’


মোহিনী-বঙ্কিমের এমন ঘন মধুর সম্পর্কের কী করুণ পরিণতি!


বঙ্কিম চাকরি নিয়ে তখন যশোরে। সেই প্রথম দীর্ঘদিন স্ত্রীকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা তাঁকে অসম্ভব পীড়ায় রেখেছিল।


একলা প্রবাস-জীবন বছর খানেক এ ভাবে চলছিল। শেষে আর থাকতে না পেরে ঠিক করলেন, যাই-ই হোক, এ বার মোহিনীকে তিনি নিয়ে আসবেন।


চিঠি লিখলেন প্রাণপ্রিয়াকে।


চিঠি পেয়ে মোহিনী উৎফুল্ল। বাড়ির সবাইকে স্বামীর দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন। নিজের সংসার পাতার আনন্দে তিনি তখন বিভোর। গুরুজনরাও মত দিলেন যশোরে যাওয়ার। স্নেহের মোহিনীর বিরহ তাঁদেরও যে কাতর করে!


ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে আসে। মোহিনী আনন্দে উত্তেজনায় হাওয়ার গায়ে ভাসেন।


বাধ সাধলেন বিধাতা। সামান্য জ্বর। অসুখের খবর পেয়ে বঙ্কিম রওনা দিলেন যশোর থেকে।


বাড়ি পৌঁছবার আগেই সব শেষ!


বাবা আর দাদার কাছে খবর পেলেন মোহিনী আর নেই! মাত্র ষোলো বছর বয়সে এ পৃথিবীর যাবতীয় মায়াবন্ধন কাটিয়ে তিনি তখন দূর নক্ষত্রের কোলে ঠাঁই নিয়েছেন!


শোকস্তব্ধ বঙ্কিম বাড়ি গেলেন না আর, মাঝপথ থেকেই ফিরে গেলেন। এর পর দীর্ঘদিন তিনি কাঁটালপাড়ার বাড়িতেই যাননি।


শুধু দাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, মোহিনীকে উপহার দেওয়া সেই দুটি কানের দুল আর চুলের সোনার কাঁটাটি যেন তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।


মোহিনীর মতোই আরেকটি মৃত্যু বঙ্কিমকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।


সে অবশ্য বেশ কিছু কাল পর। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের বিয়েরও অনেক পরে। কিন্তু শোক এখানেও পাহাড়সম।


সে বারে ছিলেন হৃদ্‌নন্দিনী স্ত্রী, আর এ বারে সন্তান!


পলা। আদরের ছোট মেয়ে। ভাল নাম উৎপলকুমারী। তাঁর স্বামী মতীন্দ্র। মতীন্দ্রর চরিত্রের দোষ। থিয়েটার পাড়ায় নটীদের বাড়িতে রাতদিন পড়ে থাকা তার নেশা। ফুর্তির জন্য পলার কাছে একদিন সে তাঁর মায়ের দেওয়া গয়নাও চেয়ে বসে।


পলা দিতে রাজি হননি।


আর তার পরই ক্ষিপ্ত মতীন্দ্র স্ত্রীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে।


শোনা যায়, ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তাঁকে মেরে ফেলে স্বামী। এর পর পলার মৃত শরীর ঝুলিয়ে দেয় কড়ি-বর্গার গায়ে।


এই কুকর্মে তাঁকে সাহায্য করে পাড়ার বিনোদডাক্তার। এর পর থানা পুলিশ। ময়না তদন্ত।


হত্যা, না আত্মহত্যা?


ডাক্তারি রিপোর্টে প্রমাণ মেলে ঘটনাটি খুন!


শুরু হল মামলা।


আদালতের বিচারে মতীন্দ্রর প্রাণদণ্ডের রায় বেরনো যখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, আশ্চর্যজনক ভাবে সওয়ালে নীরব থাকলেন দুঁদে আইনজ্ঞ বঙ্কিমচন্দ্র!


প্রাণে বাঁচলেন মতীন্দ্র।


কিন্তু কেন মতীন্দ্রকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিলেন বঙ্কিম?


এ ঘটনা কি বঙ্কিমের কোমল মনের কিংবা ক্ষমা-প্রবণতার পরিচয় দেয়?


কে জানে!


শোনা যায়, বৃদ্ধ ঠাকুর্দার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ছিল মতীন্দ্র। তাঁর অনুরোধেই নাকি বঙ্কিম মেয়ের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেন।


••••••


চুঁচুড়ার ষাঁড়েশ্বরতলায় প্রতিবছর বৈশাখ মাসে খুব জাঁকজমক করে মেলা বসত। মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হত।


তখন বঙ্কিম চুঁচুড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মেলা চলাকালীন এক দিন তিনি গঙ্গার তীরে বেড়াতে বেড়াতে দেখলেন একটি ছোট নৌকায় অনেক যাত্রী নিয়ে মাঝি গঙ্গা পার হচ্ছে।


বঙ্কিম মাঝিকে বারণ করলেন। এ ভাবে ঠাস বোঝাই করা যাত্রী নিয়ে পারাপার ঠিক নয়। না মানলে পুলিশের ভয় দেখালেন।


তাতেও মাঝি শুনল না।


যাত্রীসুদ্ধ নৌকা মাঝগঙ্গায় ডুবে গেল। মাঝি রক্ষা পেয়ে গেল। বিচারে তাকে তিন মাসের জেল-বন্দির সাজা দিলেন বঙ্কিম।


এ দিকে জেলখানাতেই মাঝি মারা গেল। তার মৃত্যুর কথা কানে গেল বঙ্কিমের। তার পর, কী অদ্ভুত! নিজে উদ্যোগী হয়ে মাঝির বিধবা স্ত্রীর জন্য আজীবন মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন বঙ্কিমচন্দ্র।


••••••


এমনিতে স্বভাবে সংযমী, স্পর্শকাতর, নম্র হলেও শরীরে রাগ যে কম ছিল, তা নয়। রেগে গেলে নাকি চুল ছিঁড়তেন বঙ্কিম।


অপছন্দের কিছু ঘটলে সহজে ছাড়তেন না। সে অন্যের কাছে যতই তুচ্ছ ঘটনা মনে হোক।


বঙ্কিমের প্রিয় হারমোনিয়ামে হাত দেওয়ার জন্য একবার ভাইপো জ্যোতিশ্চন্দ্র বেধড়ক বকুনি খেয়েছিলেন কাকার কাছে। হারমোনিয়াম বাজানোয় সিদ্ধহস্ত বঙ্কিম সইতে পারেননি তাঁর প্রিয় যন্ত্রটির প্রতি এই অনধিকার চর্চা।


এই জ্যোতিশ্চন্দ্রকে ঘিরে সঞ্জীবচন্দ্রর একটি ঘটনা যেমন। সঞ্জীবচন্দ্রর একমাত্র ছেলে জ্যোতিশ্চন্দ্রকে বঙ্কিম নিজের ছেলের মতো মানুষ দেখতেন।


জ্যোতিশ্চন্দ্র পড়াশুনোয় একেবারেই ভাল ছিলেন না। প্রবেশিকা পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করেন। বাড়িতে বসে বড়দের সঙ্গে তাস খেলে, আড্ডা দিয়েই দিন কাটাতেন। তাঁর মতিগতি অনেকটাই তাঁর বাবার ধাঁচে।


জ্যোতিশ্চন্দ্রের বিয়ের ঠিক হয় রাজা নন্দকুমারের বংশধরের পরিবারে। পাত্রের বয়স তখন মাত্র চোদ্দো। পাত্রী মোতিরানী অপূর্ব সুন্দরী।


রাজ পরিবারে বিয়ে। তাই ধুমধাম তো করতেই হবে। এমনিতেই তখন সঞ্জীবচন্দ্রের ঋণজর্জর অবস্থা।


তা সত্ত্বেও ছেলের বিয়ে দিতে আরও ঋণ নিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। এলাহী আয়োজন। ধুমধাম ঘটার যেন সীমা নেই। কাঁটালপা়ড়া থেকে হাতির পিঠে চাপিয়ে বরকে নিয়ে যাওয়া হল সালকিয়ার শ্বশুরবাড়ি।


পুরো ব্যাপারটিতে বেজায় চটেছিলেন বঙ্কিম। বিয়ের জন্য আবার টাকা ধার চাইতে গেলে প্রচণ্ড রেগে যান তিনি।


কড়া ভাষায় দাদাকে বলেন, ‘‘যে ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবেন না মনে জানিয়াছেন, তাহা গ্রহণ করা পরকে ফাঁকি দিয়া টাকা লওয়া হয়।’’


আরেকটি ঘটনা যেমন।


বঙ্কিমের বড়দাদা শ্যামচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে শচীশচন্দ্রের বিয়ে।


বিয়ে হচ্ছে সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের সঙ্গে। পাত্রী সুরেশ্বরী। ভাইপো পাইকপাড়ার জমিদারদের কাছ থেকে পোশাক ধার করে একেবারে রাজপুত্র সেজে এসেছেন।


রাজবেশে বর নামছেন।


বিবাহে উপস্থিত বিদ্যাসাগর।


বিদ্যাসাগর বরের হাত ধরতে গেলেন। তাতে রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন।


পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাইপোর এমন আচরণ দেখে তিনি অগ্নিশর্মা! — ‘‘তুমি জানো ইনি কে? ইনি বিদ্যাসাগর! এক্ষুনি ক্ষমা চাও।’’


মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন শচীশচন্দ্র।


তবে একটা কথা কী, রাগান্বিত বঙ্কিমের যত গল্প, সবই প্রায় তাঁর পরিবারের লোকজনকে ঘিরে। বাইরের মানুষের কাছে তিনি প্রায় বিপরীত।


তবে নিজের বিশ্বাস জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি সচরাচর পিছু হটেননি। ছিলেন অকুতোভয়ও। সে ঘরেও যেমন, তেমন বাইরেও।


আর আপস? তা বোধহয় বঙ্কিমের ধাতে ছিল না।


এমন লৌহমনা বঙ্কিমের পরিচয় দিতে তাঁর চাকরি জীবনে তাকানো যেতে পারে।


বঙ্কিম তখন খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট। এক নীলকর সাহেব হাতির শুঁড়ে মশাল বেঁধে একটা আস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেন। তখনও বেঙ্গল পুলিশের সৃষ্টি হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে পুলিশ কাজ করত।


দারোগারা কোনও ভাবে সাহেবকে ধরতে পারল না। তার কারণ, সাহেবের কাছে সব সময় গুলি ভরা পিস্তল থাকে। কিন্তু বঙ্কিম পিস্তলের তোয়াক্কা না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সাহেবকে ঠিক গ্রেফতার করলেন।


আরেকবারের ঘটনা বলা যাক।


তখন যশোরে। পঞ্চম শ্রেণির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। পঞ্চম শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণি অবধি উঠতে লেগেছিল তাঁর দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর।


মাঝে কিছু দিনের জন্য পেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ। তবে দ্রুতই এই পদটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। বঙ্কিম ফিরে যান ডেপুটির পদে।


কারণ? উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’!


বঙ্গদর্শন-এ উপন্যাসটি বেরনোর সময় প্রকাশ বন্ধর হুকুম জারি হয়।


বঙ্কিম মানেননি।


আবার এই অবজ্ঞার কারণে তাঁর মতো দক্ষ অফিসারকে পদচ্যুত করা, সে’ও তো কঠিন কাজ!


উপায়? পদটিই লুপ্ত করে দেওয়া হল।


বঙ্কিম অবশ্য নিস্তার পাননি তাতেও। ক্রমাগত তাঁকে বদলির চক্করে ফেলে হয়রান করা চলল। বছরে দু’তিন বার করে বদলি। কখনও আলিপুর বা বারাসাত, তো কখনও জাজপুর বা ভদ্রকে। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে বিরক্ত হয়ে শেষে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়ে নেন বঙ্কিমচন্দ্র। সভাসমিতিতেও বিশেষ যেতেন না। ভীষণ রাশভারী মানুষ ছিলেন। বলতেন, ‘‘যে সময় বৃথা সভাসমিতিতে কাটাব, সে সময়টা বসে লিখলে কাজ দেবে।’’


••••••


বঙ্কিমচন্দ্র দ্বিতীয় বিবাহ করেন হালিশহরের সীতারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা রাজলক্ষ্মীকে। প্রথম স্ত্রী মোহিনী মারা যাওয়ার তখন আট মাস কেটে গেছে।


রাজলক্ষ্মীও গুণবতী। সুন্দরী।


বিয়ের চার বছর পরে তাঁদের প্রথম সন্তান শরৎকুমারীর জন্ম।


এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। মোহিনীদেবীর সেই যে দুল, কাঁটা— ও দু’টি বঙ্কিম বহুকাল রাজলক্ষ্মীকে দিতে পারেননি।


অন্য অনেক অলঙ্কার দিলেও মোহিনীকে দেওয়া গহনা কিছুতেই না। নববধূ রাজলক্ষ্মীকে বলেছিলেন, ‘‘এগুলি এখন আমার কাছেই রইল। যে দিন তোমায় ভালবাসিব, সে দিন দিব।’’


শরৎকুমারীর জন্মের তিন মাস পর সেই অলঙ্কার রাজলক্ষ্মীর হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন বঙ্কিম। সে তুলে দেওয়ার মধ্যে সে এক অপূর্ব প্রেমাতুর ভঙ্গি! নৌকায় পাড়ি দিতে দিতে নিজে হাতে স্ত্রীর কানে দুল আর চুলে কাঁটা লাগিয়ে দিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


বঙ্কিম বড় চাকরি করতেন, কিন্তু ধনী ছিলেন না। কারণ একান্নবর্তী পরিবার। ভাইদের সংসারও বঙ্কিমকে সামলাতে হতো। মেজদাদা সঞ্জীবের সংসারের পুরো দায়িত্বই ছিল বঙ্কিমের ওপর। সঙ্গে পরিজনদের চিকিৎসা, অন্নবস্ত্র, সব কিছুর কথাই ভাবতে হতো তাঁকে।


স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দিনে দিনে যে কেবল চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ‘কল্যাণস্বরূপা’ হয়ে উঠেছিলেন, তা নয়, বঙ্কিমের সাহিত্যিক বন্ধুদের কাছেও ছিল তাঁর অসীম গুরুত্ব। তাঁদের আপ্যায়নও তাঁকেই করতে হত।


স্বভাবগম্ভীর রাজলক্ষ্মী ভাল রান্না জানতেন। অতিথি এলে রাজলক্ষ্মীর হাতের রান্না না খাইয়ে বঙ্কিম পারতপক্ষে কাউকে ছাড়তেন না।


বঙ্কিম ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর কাছে খরচপত্রের দায়দায়িত্বও তুলে দেন। এমনকী নিজে চিঠিপত্র লেখারও যখন সময় পেতেন না, লিখে দিতেন রাজলক্ষ্মীদেবী। বঙ্কিম কেবল সই করে দিতেন।


রাজলক্ষ্মীর প্রতি এত নির্ভরতা ছিল যে, বলতেন, ‘‘তিনি না থাকিলে আমি কী হইতাম, বলিতে পারি না।’’


রাজলক্ষ্মীর প্রতি এত টান, অথচ শেষ দিন পর্যন্ত মোহিনী যেন বঙ্কিমের অবচেতনে ডানা মেলে ভেসে বেড়াতেন তাঁরই গহীন অতলে। মৃত্যুশয্যায় যখন অর্ধচেতন অবস্থা, যন্ত্রণায় কাতর, তখন রাজলক্ষ্মী নয়, বারবার বলেছিলেন একটিই নাম— মোহিনী, মোহিনী!—‘‘আমি এ বার তার কাছে যাব।’’


••••••


এমনিতে স্বভাবে বঙ্কিম সংযমী। কিন্তু খাবার বেলায় মাংস খেতেন অপরিমিত। অল্পবিস্তর মদ্যপানও করতেন। চেষ্টা করেও যে মদ খাওয়া ছাড়তে পারেননি, তার জন্য অবশ্য তাঁর গ্লানিও ছিল।


চিকিৎসকরা বলেছিল, ডায়াবেটিক মানুষ মদ্যপান করলে শারীরিক সমস্যা বাড়ে। বঙ্কিমেরও বেড়েছিল। কিন্তু তাতেও সুরা ছাড়তে পারেননি। বঙ্কিমের বাড়িতে নিয়মিত পোর্ট ওয়াইন আসত। নিজে পরিমিত খেতেন, কিন্তু অন্যে অপরিমিত খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়লে সামালও দিতেন তিনি।


[FROM AN ARTICLE PUBLISHED IN ANANDA BAZAR PATRIKA ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ