বাঙালি পাঠকের এক বড় ভুল ধারণা হলো—শিল্পী মানেই বোহেমিয়ান, কবি মানেই অগোছালো, লেখক মানেই ভাঙাচোরা জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁকে অবশ্যই রাতভর মদ খেতে হবে, সংসার ভাঙতে হবে, পথে পড়ে থাকতে হবে। তাঁর ঘর বলতে হবে ধুলোমাখা খাট, ছেঁড়া কাগজ, এলোমেলো বইয়ের স্তূপ। যেন বিশৃঙ্খলাকে মহৎ সৃষ্টির একমাত্র শর্ত হিসেবে কল্পনা করা ছাড়া আর কিছুই আমরা জানি না। কিন্তু সত্যিটা এরকম নয়।
বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখবেন—মহৎ স্রষ্টারা ছিলেন ভীষণ শৃঙ্খলাবদ্ধ। কাফকা অফিসের চাকরির ক্লান্তি নিয়েও প্রতিদিন রাত ঠিক সময়ে লিখতে বসতেন। ভার্জিনিয়া উলফ ছিলেন অসুস্থতায় জর্জরিত, তবু লিখতেন অবিশ্বাস্য নিয়মে। মার্শেল প্রুস্ত তাঁর রোগশয্যায় থেকেও প্রতিদিন নির্দিষ্ট ঘণ্টার কাজ শেষ না করে বিশ্রাম নিতেন না। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো রচিত হয়েছে এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভেতরে—তাঁর ব্যক্তিজীবন যতই রহস্যে ঢাকা থাকুক, তাঁর লেখকজীবন ছিল অদ্ভুত সুশৃঙ্খল।
এমনকি আমাদের বাঙলাতেই উদাহরণ কম নেই। নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী, দুঃখভোগ করেছেন অসীম, কিন্তু তাঁর প্রতিটি লেখা জন্ম নিয়েছে এক আশ্চর্য শৃঙ্খলার ভেতরে। সুকান্ত, অকালমৃত হলেও, লিখেছেন তীব্র জীবনবোধ ও কর্মের মধ্য দিয়ে। আর রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই—দুঃখে-শোকে ভরা জীবনের ভেতরেও তাঁর সৃষ্টির ভাণ্ডার কখনো ফুরোয়নি, প্রতিটি কাজেই ছিল প্রস্তুতি ও সুনিপুণ পরিকল্পনা। ঋত্বিক ঘটককে নিয়েও ভুল ধারণা কম নেই। তাঁকে আমরা অনেক সময় দেখি মদমত্ত, ভগ্ন, অকালমৃত এক শিল্পী হিসেবে—যেন তাঁর অগোছালো জীবনই তাঁর সিনেমার আসল উৎস। কিন্তু সত্যিটা হলো, তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র এক অসাধারণ পরিকল্পনা, নিখুঁত প্রস্তুতি ও শৃঙ্খলার ফসল।
কোনো শিল্পীর জীবনেই দুঃখ, কামনা, ব্যর্থতা, মদ, রোগ—এসব আসতে পারে। এগুলোই তাঁকে লেখক বানায় না। লেখককে লেখক বানায় তাঁর নির্দিষ্ট টেবিল, তাঁর কলমের প্রতি দায়বদ্ধতা, প্রতিদিনকার নির্ধারিত পরিশ্রম। সাহিত্য নিছক অগোছালো জীবনের হঠাৎ ঝলক নয়; সাহিত্য হলো দীর্ঘস্থায়ী অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার ফসল।
যে জীবনে প্রতিদিনকার শৃঙ্খলা নেই, একাগ্রতা নেই, সেই জীবন থেকে কালজয়ী রচনা জন্ম নেয় না। শিল্পী হতে হলে প্রথমেই হতে হয় নিয়মানুবর্তী। বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকেও তাঁকে খুঁজে নিতে হয় এক ভেতরের শৃঙ্খলা। আর সেই শৃঙ্খলাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে আলাদা করে তোলে, দেয় অমরত্ব।
শিল্পীজীবন নিয়ে যে ‘অগোছালো’ মিথটি ছড়িয়ে আছে, তার একটি সামাজিক ব্যাখ্যা রয়েছে। আমরা অনেক সময় শিল্পীর ব্যক্তিগত ভাঙনকে তাঁর সৃষ্টির মূল বলে ভেবে নিই। কারণ দুঃখ, মদ, বা ভাঙাচোরা প্রেম আমাদের কাছে রহস্যগল্পের মতো আকর্ষণীয় শোনায়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই—এই গল্পের বাইরে প্রতিদিনকার কাঠিন্য, প্রতিদিনকার নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া কোনো শিল্প দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
অন্যদিকে, বাজার ও গণমাধ্যমও এই মিথকে শক্তিশালী করেছে। লেখকের দুর্ভোগকে বিক্রি করার মতো গল্পে রূপান্তরিত করা সহজ, কিন্তু তাঁর নিরলস নিয়মমাফিক কাজকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে না। তাই বোহেমিয়ান ইমেজটিই বারবার প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ বাস্তবে একজন কবি বা ঔপন্যাসিকের দৈনন্দিন জীবন দেখতে গেলে পাওয়া যাবে শৃঙ্খলার কঠিন কাঠামো, যার ভেতর দিয়ে তিনি নিজের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাকে কণ্ঠস্বর দেন।
লিও টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, কিংবা জেমস জয়েস—যাঁদের জীবন নিয়ে অসংখ্য কিংবদন্তি ছড়ানো আছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই সত্য। টলস্টয়ের আধ্যাত্মিক টানাপোড়েন, দস্তয়েভস্কির জুয়া ও ঋণ, জয়েসের নির্বাসিত জীবন—এসবই আকর্ষণীয়, কিন্তু এদের বাইরেও ছিল প্রতিদিনকার লেখার টেবিল, একাগ্র অনুশীলন। দস্তয়েভস্কি তাঁর ‘দ্য গ্যাম্বলার’ লিখেছিলেন নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর, প্রায় সামরিক শৃঙ্খলায়। জয়েস তাঁর ‘ইউলিসিস’-এ প্রতিটি বাক্য নিয়ে বছরের পর বছর কাজ করেছেন। কঠোর শৃঙ্খলা ছাড়া এত বড় শিল্পকর্ম জন্ম নিতে পারত না।
বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাকালে দেখা যায়, আমাদের কবি-লেখকদের অনেককেই ভুলভাবে ‘অগোছালো’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। আবুল হাসানকে যেমন শুধুই বোহেমিয়ান বলে দেখা হয়, অথচ তাঁর কবিতা পড়লেই বোঝা যায়—তিনি ছিলেন গভীরভাবে প্রস্তুত, প্রতিটি শব্দ বাছাই করেছেন তীব্র শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে নিয়ে একই বিভ্রান্তি আছে। তাঁর অকালমৃত্যু, রাজনৈতিক চাঞ্চল্য—এসবই বেশি আলোচিত হয়, কিন্তু তাঁর কবিতার ভিতরে ছিল সযত্ন শ্রম ও সচেতন নির্মাণ।
শিল্পের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক জটিল। তবে এর অর্থ এই নয় যে বিশৃঙ্খলা থেকেই শিল্প জন্ম নেবে। বরং বলা যায়, শিল্প হচ্ছে এক প্রকার প্রতিরোধ—জীবনের অস্থিরতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির মাধ্যমে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। কবিতা বা গল্প আমাদের যে সৌন্দর্যের স্বাদ দেয়, তা আসলে লেখকের ভেতরের এই আত্মনিয়ন্ত্রণেরই ফল।
আজকের সময়ে, যখন আমরা ‘কনটেন্ট’ আর তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তির যুগে বাস করছি, তখন শৃঙ্খলার গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। কারণ মুহূর্তে ভেসে যাওয়া লেখালেখি হয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুদিন আলোচনায় থাকে, কিন্তু টিকে থাকে না। যে কাজ সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকে, তা আসে অধ্যবসায় থেকে, প্রতিদিনকার কঠোর পরিশ্রম থেকে।
অতএব, শিল্পী মানেই অগোছালো—এই ধারণা এক ধরনের অলস কল্পনা। শিল্পী আসলে হন সেই মানুষ, যিনি নিজের জীবনকে গুছিয়ে নেন সৃষ্টির জন্য। তিনি যতই দুর্বল হোন, ভেতরে যতই দ্বন্দ্ব থাকুক, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে টেবিলে বসেন, কলম হাতে নেন, অথবা ক্যামেরা চালান। এই নীরব নিয়মই তাঁকে আমাদের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী করে রাখে।
0 মন্তব্যসমূহ
অমার্জিত মন্তব্য করে কোনো মন্তব্যকারী আইনী জটিলতায় পড়লে তার দায় সম্পাদকের না৷