New

শ্বেতপত্র

মাথা ভাঙা গণেশ / ভীষ্মদেব সূত্রধর


এখন শরতকাল, যেখানে নদীর ধারে কাশফুলে ছেঁয়ে যেত ডাঙা, সবুজ ঘাসে ফুটত দুধরঙা ফুল অথবা পারিজাতের  মোহনীয় সুবাস বলে দিত  সংলগ্ন বাতাসকে, সেই ঘাসের সেই মাটির দেশ আজ কেমন যেন ধূসর বিরান!
কেদার রায় তাঁর দোকান উদ্বোধন করেছিল গেল বছর, সিদ্ধিদাতা গণেশের পূজো করতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল, কথাটি ঠিক নয়- আসলে আজকাল ওসব মানে কজন? সে বাস্তববাদী, সে পরোপকারী মানুষ। তথাপি ব্যবসা জমছে না, মা পই পই বলে দিলেন, সব অশুভশক্তি বাবা, অন্তত বারের পূজাটা কর!
কেদারের সেই গোঁ- ধুরু মা।
এবার আসছে শারদীয়ায় তাই মায়ে'র আবদার বারোয়ারী পূজায় সেই গাফিলতি যেন না হয়। যুক্তি অনেক খাটলো বৈকি, তবু কেদার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, দেখব।
পাড়ায় একখানাই মন্ডপ তাও জীর্ণ,  যা এদেশের বহু মানুষের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একশ পাঁচ বছর.. সরকারি হিসেবে বেড়েছে মন্দির, পূজো, কিন্তু জীর্ণতা কমেনি সনাতনী মানুষের ও তাদের পিষনের বূহ্য। শহরের মন্ডপে তাও কমিশনার ডিসি এসে পাঁচশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যান কিন্তু এখানে ওয়ার্ড কমিশনারও আসতে কুন্ঠাবোধ করেন যে শেষে তওবা পড়তে হবে মুসল্লীদের জবরদস্তিতে।
একমাস পূর্বেই পাল দাদা মাটি ছেনতে শুরু করেছে, খড় বাঁশ কাঠের ফ্রেম তৈরি প্রায়। সে তার নিত্য কাজ, নিত্য জীবনের আহারাদির সংস্থান।
সেবার বিদ্যাদেবীর পূজায় তার আয় হয়েছিল অনেক কিন্তু অধিক মুখে ভাত জোটাতে নুয়ে পড়েছে শরীর, তাতে কুলিয়ে উঠতেই মাটিতে মিশে যায় সে।
সরকার মশায় সভাপতি, তেজি কিন্তু খুশমেজাজী, তাঁর কথা- এবার গণেশের ভুঁড়িটা বড় করে দিও পাল দাদা, কেদার রায়ের পয়সা যেন ভুঁড়ি ভুঁড়ি হয়।
পাল দাদা হাসে। আবার কাজে মন দেয়।
কেদার বুঝে উঠতে পারেনা, টাকার সাথে গণেশের ভুঁড়ি কি করে যুক্ত। তাই বলে, তাহলে গণেশের বদলে সরকারকেই বসাও ছাঁচে, ওর তো বেশ...
সরকার কথা কেড়ে নিয়ে বলে, হা তুমি তো জিম করা কার্তিক। 
পাল দাদা চশমাটা উঁচু করে নাকের ডগায়, বলে, সে আমি জানি, আমায় আর্ট শেখাতে এসো না বাপু।
তার কথা পৌছল কিনা তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসল।
জবাব না পেয়ে পাল দাদা মাটি লেপন করতে শুরু করল।
ছোট ছোট আধ নেংটো ছেলে মেয়েরা মনযোগ দিয়ে দেখছে মূর্তি গড়া, মাঝে মাঝে পাল দাদার সাহায্য করতে পেরে একে অপরের বুক ফুলে উঠছে, দেখছিস আমি দিলাম
আরেকজন বলল, আমায় বলছে তুই দিলি...!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা, তারপর রাত নামে, তল্লাটে অন্ধকার ছেঁয়ে ধরে ঘন নিঃশ্বাসের।  ফিস ফিস হয় ওখানে সেখানে...
রাতে যখন বাড়ি ফেরে, বাইরের গেটে শেকল তুলে জুতো জোড়া রাখে সিঁড়ির উপর, জানে মা ঝিমোচ্ছে তাই এক প্রকার চুপিচুপি মুখ- হাত -পা ধুয়ে মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডাকে মাকে। সে দীর্ঘশ্বাস কি বলে দিতে পারে হেঁটে চলা জীবন, বলতে পারে একার এক নিরালায় নিরলস পরিশ্রমের কথা, ভাবতে আজকাল বসে কই, দোকানের হিসেব করতে যখন রাত্রি দশটা পেরিয়ে যায় তখন দোকানী ছেলেকে সমস্ত গুছিয়ে দিয়েই ফেরে। কয়েকবার মা মা ডাকবার পর ঘুম কাতর চোখ  নিয়ে মা যখন বাসন কোসনে হাত লাগায়, তখনি নিস্তব্ধতা ভাঙে এ বাড়ির, কথা শোনা যায় মানুষের। 
খাওয়া সেরে মশারি টানায়, মা বকে যায় এ কথা ও কথা, মাঝে মাঝে বিরক্তিভাব প্রকাশ করে মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে মা, কেদার সবশেষে শোনে, বলে, হলো কি
কিছু আর হবার আছে? বলেই জবাবের অপেক্ষায় থাকে। কেদার ঠোঁট কামড়ে বলে, মা পূজা শেষ হলেই তো.. চিন্তা করো না
- আমি ভাবছি এবার পিতুকে নিয়ে আয়। মেয়েটা বাপের বাড়ি আসেনা কতকাল
- কত কাল?
- এই তো গেল!
মা মুখ বাঁকা করে বসে থাকে। ঘুম কাতরতা কোথায় খেই হারায় বুঝে উঠতে পারে না কেদার। তাই জোর করেই বলে, যাও ঘুমাও 
 হা যাই। হাই তুলে ধীর পদে চলে যায় মা। বাতি নিভিয়ে ভাবে। কি ভাবে তা আমাদের জানা নেই। আসার পথে আজগরের সাথে দেখা হয়েছিল, সামনে এসেই লম্বা সালাম দিয়ে  বলে, আলহামদুলিল্লাহ দাদা, কেমুন আছেন?
জবাবও দ্রুত দিয়ে কেটে পড়তে চায় সে। ভাল বলেই যাবে কিন্তু আজগর বলল, এবার ঢাক না বাজালেই ভাল।
পরক্ষণেই বলে, পূজা কবে দাদা?
ঠাওর করতে কষ্ট হলো কি জবাব দেবে, দূরে তাকিয়ে কি বলল আজগর গওর করেনি যদিও, সেও চলে গেল ঠোঁটের কোণায় বদ হাসিটুকু নিয়ে, অজগর বলে যার নিন্দে চারপাশ, যে অমুক তমুক সেক্রেটারি তার সাথে কি কথা বলবে কেদার! একবার ভাবলেশহীন আকাশে চোখ তোলে, লম্বা সারিবদ্ধ মেহগনির মাথার ওপর মাখন চাঁদ দেখে, তারপর পা বাড়ায়..
কালীতলার দুটো দোকান বেশ জমে উঠেছে, ওখানে সান্ধ্য আড্ডায় মগ্ন থাকে মুহাম্মদ ঘুরীর ঘোড়ার পাছা ধোয়া বিনা মাইনের বংশধরেরা। পান চিবোয়, গুল গোঁজে, পিক ফেলে লাল করে ঝাট দেয়া রাস্তা, কথা হয় গুরু-গম্ভীর এবং জান্নাতের টিকিট সম্পর্কিত  ইত্যাদি।  আধবুড়ো হেকমত গলার স্বর ভারী করে কিন্তু ধীরে বলে চলে, এই কন কথা ঠিক কি না
যারা পূর্বেই ছিল তার মাথা নাড়ে, দু একজন ঠিক ঠিক বলে, যারা নতুন এসে বসে তারাও হা হু ই বলে উসকে দেয়, হেকমত বলে, তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্ত্ত অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ -সূরা হজ্জ : ৩০
যুবকেরা শোনে। কিছু বলতে চায় হুজুরকে, কিন্তু হুজুর যুবকদের উদ্যেশ্যে কথা ছোড়ে, বাবারা বুঝলা কিছু..আ
মাথার টুপি ঠিক করে কোনো যুবক হাসে, কেউ হুজুরকে বলে, হুজুর মালাওন..
হেকমত, করিম, নবীদুল হেসে ওঠে। করিম বলে, বাবারা হুজুর তো তাই বলতেছে, তোমরা সবে আসলা শোন আগে!
রাত বাড়ে, পরিত্যক্ত খাল থকে ভেসে আসে ঝিঝির গুঞ্জন, রাতচোরা পাখির আর্তনাদ, বাতাস বিবাগী তাই গায়ে লেগে ফিরে যায় যেন। আলোচনা চলে, পাড়ায় পাড়ায় কথা হয় এবার থামাও মিয়ারা, আর কত? কেউ কেউ মুখ সাহসে চপলতা দেখালেও তারা ভয়ে থাকে, আইনের? শাস্তির? কিসের? কেউ কথা কইতেই ফুঁসে ওঠে, আলবদ জবাব দেবো।
মিটিং শেষে যে যার বাড়ি যায় কিন্তু কেদারের বাড়ির সামনে বা সতীশের বাড়ির সামনে অথবা সরকারের বাড়ির সামনে এসে হঠাৎ করে চিৎকার করে সমস্বরে, নারায়ে তকদির.... 
প্রায় প্রায় তাই হয়, কেদারের ঘুম ভাঙে, স্বপ্ন শেষে, যেন গণেশ কার্তিক মানুষ সেজে বলছে, এবার ল্যাঠা চুকা।
কেদার জানে কার পেটে সিঁধে আছে কুবের।  তাই অবিশ্বাস হলেও উৎসব যেন আচারকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই, ভোগ আর অর্চনাই নয় আছে মাখোমাখো অনুভূতি, পূজোটা গৌণ বটে! স্রে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ