New

শ্বেতপত্র

গল্প: প্রতিশ্রুতি | সানজিদা হাসনাত সূচনা


"তারারাও যতো আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে, তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে ..."

পৃথিবীটা ছোট হয়ে ড্রয়িংরুমের বোকা বাক্সতে বন্দী হবার পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি লেখা হয়েছিলো। সেই পৃথিবীটা এখন আরো ছোট। ড্রয়িংরুমের বোকা বাক্স ছোট হতে হতে বেডরুমে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আজ আমরা পাশাপাশি বসে থাকি, কিন্তু আমাদের সংযোগ বড় কম। মানুষ আজ মানুষ থেকে ভয়ানক বিচ্ছিন্ন। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নতা থাকবেই, কিন্তু পুঁজিবাদের এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে এই বিচ্ছিন্নতা আরো প্রকট হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আমরা কতোই না অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি। নৃশংসতার দৃশ্য দেখে স্ক্রল করতে করতে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাচ্ছি। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার আর ইউটিউব চ্যানেলে আমরা কি ক্রমাগত সুখী থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি? এই যান্ত্রিকতা কি আমাদের প্রেমের ধরনকেও পাল্টে দিচ্ছে?  কোনো মেয়েকে তোমার যদি ভালো লাগে তাহলে আজকের দিনে তুমি প্রথমেই কী করো? তার ফেসবুক আইডি খোঁজার চেষ্টা করো। তার ছবিগুলো দেখো।


 হ্যাশট্যাগ "ক্যান্ডিড" লেখা ছবিতে তুমি হয়তো সেই মেয়েটিকেই  একটা ভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখো, যেখানে তাকে অনেক রহস্যময় এমনকি আকর্ষণীয় মনে হতে পারে! তুমি তখন তার প্রোফাইলে যাও এবং ছবিগুলো দেখো! তার পুরনো মজার সব ছবি দেখে তোমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে আর তুমি তার প্রেমে পড়ে যাও! কাঁচের বোতলে মুুখ লাগিয়ে সে যখন কোক খায়, তার সেই নিষ্পাপ মুখ দেখে তুমি প্রেমে পড়ে যাও, তার এলোমেলো চুল যখন তার মুখের ওপর এসে পড়ে, সেটা দেখে তুমি প্রেমে পড়ে যাও! আর সেই ছবিটা দেখে তোমার হৃৎস্পন্দন এক মূহুর্তের জন্য থেমে যায়, যেখানে সে তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, তুমি হয়তো জানোওনা সে আসলে কী কারণে হাসছিলো! তার লেখা ক্যাপশনগুলো দেখে তুমি প্রেমে পড়ে যাও এবং একদিন তাকে বলে বসো, ``আই লাভ ইউ"!

থামো ছেলে! যখন তুমি তার ফিল্টার করা ছবি আর কিছুটা কৃত্রিমভাবে তৈরী করা ``ক্যান্ডিড" (সেগুলো কি আদৌ ক্যান্ডিড বলা যায়?) দেখে প্রেমে পড়ে যাও, তুমি কি নিশ্চিত তুমি তাকে তখনো ভালোবাসতে প্রস্তুত যখন তার কোনো মেক আপ থাকবেনা, তার চুল এলোমেলো থাকবে আর কাজ করতে গিয়ে তার আঙ্গুল গুলোতে আঠা মেখে থাকবে? যার কোকের বোতলে চুমুক দেয়ার ছবি দেখে তুমি তার ঠোঁটের প্রেমে পড়েছিলে, তুমি কি নিশ্চিত সে যখন মুখ অর্ধেক হা করে ঘুমাবে তখনো তার প্রেমে পড়বে তুমি? তুমি নিশ্চয়ই জানোনা যখন তার ঠান্ডা লাগে তখন মাঝে মাঝে তার ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার শব্দ হয়! কারণ ইনস্টাগ্রামের ছবি তোমাকে এই তথ্যগুলো দেয়না! তুমি কি তখনো তাকে ভালোবাসবে যখন সে নিজের মনের কথা বলবে এবং তার নিজের মতামত জোরালোভাবে প্রকাশ করবে? কারণ, সে কিন্তু তার ছবির মতো বোবা নয়! 

তুমি কি মেনে নেবে তার মধ্যরাতের অনর্গল বকবক অথবা তার নীরবতাকে যখন সে নিজের ভেতরে এতোটাই মগ্ন যে, সে পিজ্জার শেষ টুকরোটি খেতেই ভুলে গেছে অথচ সেটা নিয়ে তোমরা সাধারণত মারামারি লাগিয়ে দাও! তুমি কি তার বাম উরুর ক্ষতচিহ্নটাকেও ভালোবাসবে যেটা সে কেটেছিলো এক ছেলের সাথে ছয় বছরের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর যার সাথে সে বাকি জীবনটা কাটানোর কথা ভেবেছিলো? তুমি কি মেনে নেবে তার জীবনের গভীরতম শঙ্কা আর গোপনতম ঘটনাগুলোকে? শোনো ছেলে, সে তার ফেসবুকের স্ট্যাটাস আর সুখী ছবিগুলোর চাইতেও বেশী কিছু!

সে যখন কোনো উপন্যাসের চরিত্রের মৃত্যুতে কাঁদতে থাকে, তার চোখের নিচের কালো দাগ কি তোমাকে তখনো যথেষ্ট আকর্ষণ করবে? তুমি কি তাকে এতোটা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে যেন সে কান্নার কথা ভুলে যাবে? তুমি কি নিশ্চিত সে যখন খুব জোরে হাসে তখন যে বিশ্রী শব্দ হয় সেটা তার প্রতি তোমার ভালোবাসা কে প্রশ্নের মুখে ফেলবেনা? সে যখন কোনো ফালতু জিনিস দেখে বিরক্ত হয়ে জোরে চিৎকার করে ওঠে, তখনো কি তুমি তাকে যথেষ্ট ভালোবাসবে এটা মনে না করার জন্য যে, সে কোনো বাড়াবাড়ি করছে না? সঙ্গম শেষে তুমি যখন পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়তে চাও অথচ সে চায় তোমার সাথে গল্প করতে আর তার নিরর্থক প্রশ্নগুলো তোমাকে বিরক্ত করে তোলে, তুমি কি তখনো তার দিকে সেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাবে, এতোকাল যেমনটা ঘটেছে? আর আমি কী করে ভুলবো, যখন মাঝরাস্তায় সে তোমার হাতে একটা ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়াবে আরেকটি সাজানো "ক্যান্ডিড" এর জন্য, বলো প্রিয়তম, তুমি কি তখনো ভালোবাসবে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ