New

শ্বেতপত্র

গল্প : ভিনদেশী বৈশাখ/ ফাতেমা সুলতানা




নীরার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ তবে ঘুমের রেশ কাটেনি। মাথায় বাজছে পাখির মিষ্টি কিচিরমিচির। আড়মোড়া ভেঙে সে বিছানায় উঠে বসে। বেশ রোদ উঠে গেছে বাইরে। লস এঞ্জেলসে নিজের ছোট্ট এপার্টমেন্টে সুন্দর আরেকটি সকালের সূচনা।জানালায় নাম না জানা নীল লেজের পাখি দু'টো আবার এসে বসেছে। এদের শব্দেই ঘুম ভেঙেছে নীরার। তাকে উঠতে দেখে পাখি দু'টো জানালার গ্রিল ছেড়ে ওপাশের রোজ ক্যাকটাসের ঝাড়ে গিয়ে বসল। চুপচাপ, কিচিরমিচির করছে না আর তবে বেশ মায়া মায়া চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে নীরার দিকে। আজকাল পাখিদু'টোর নানা অভিব্যক্তি বুঝতে পারে নীরা। মিষ্টি হেসে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। ফ্রেস হয়ে এক কাপ কফি আর দুই টুকরো বিস্কুট নিয়ে রুমে আসে । বিস্কুটের টুকরো দুইটি জানালার ধারে রাখতেই আবার উড়ে এসে কুটকুট করে খেতে লাগে পাখি দু'টো। বড্ড ভাল লাগে নীরার। সে পাখি দু'টোর নাম রেখেছে। লম্বা লেজের পাখিটা হল উশি আর একটু খাটো লেজের পাখিটা তুশি। সকালটা এদের সাথেই বেশ কেটে যায় তার।
.
লস এঞ্জেলসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া - তে বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছে নীরা। শহরের বেশ নামকরা এক পাবলিক লাইব্রেরিতে বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ডিউটিতে পার্টটাইম জব করে। বইয়ের রাজ্যে বুঁদ হয়ে থাকতে বেশ ভাল লাগে। বিকেলে ডিউটিতে যেতে বের হয় সে। লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেখে আজকে ভীর কম। উইকএন্ড- এর পর আজ বেশ ব্যস্তময় একটি দিনা কিনা! নিজের কাজের ডেস্কে গিয়ে বসে সে। একগাদা বই স্তূপ হয়ে আছে সেখানে। লিস্ট করে সব শেলফে তুলতে হবে।সকালের ফুরফুরে ভাবটা এখনও আছে তার। তবে হুট করেই মেজাজ গরম হয়ে গেল। লালচুলো ছেলেটা আবার এসেছে! এত সময় থাকতে বেছে বেছে ওর ডিউটির সময়ই কেন যে এ আপদ এসে হাজির হয় জানে না সে। মার্টিন ওর নাম। নীরারই ব্যাচমেট। বড্ড বাচাল, বানরের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। কথা বলার ধরণটাও ভাল না। হাত - পা নেড়ে, থুথু ছিটিয়ে সবসময় কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে বকবক করতেই থাকে। নীরা ওকে একদম পছন্দ করে না।
তবে হ্যাঁ, নীরা ওকে পছন্দ করলেও করতে পারতো। ব্যাচমেট হলেও মার্টিনের সাথে তার পরিচয় ভার্সিটিতে না, এই লাইব্রেরিতেই। নীরা তখন সবেমাত্র জবে ঢুকেছে। পাবলিক লাইব্রেরি বিধায় নানা দেশের, নানা রকম মানুষের আনাগোনা। সে নিজেও বিদেশি নতুন নতুন বই আর লেখকের সাথে পরিচিত হচ্ছে। বই গোছানো, পাঠকদের কাঙ্ক্ষিত বই খুঁজে দেওয়া, তাদের নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করা - এসব করে সময়টা ভালই কেটে যেত। হঠাৎ একদিন লম্বা মত, রোগা এক ছেলে এসে জিজ্ঞেস করে যে বাংলাদেশের উপর লেখা বইগুলো কোনদিকে পাওয়া যাবে। নীরা অবাক হয়। ছেলেটির চোখে চশমা, চশমার ওপাশে কালো, বুদ্ধিদীপ্ত দু'টি চোখ; কথায় কড়া ব্রিটিশ টান। তবে গায়ের রংটা একটু মলিন; শ্বেতাঙ্গদের মত ওতটা ঝকঝকে, তকতকে নয়। এই ছেলে বাংলাদেশের বই কেন খোঁজে? চুপচাপ সে বইগুলো দেখিয়ে দেয়।
আর তারপর থেকেই দেখে ছেলেটি এখানে বাংলাদেশ নিয়ে লেখা বইগুলোর মধ্যে নাক গুঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। মাঝে মাঝে নোটবুক বের করে কী কী যেন টুকে নেয়। ক্যাম্পাসেও বার কয়েক দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে। দেখা হলেই 'হেইইইই নীঈর্যা' বলে এত জোরে হাই দেয় যে আশেপাশের সবাই নীরার দিকে তাকায়। খুব অস্বস্তি লাগে তখন। তবে কিছু বলে না সে। হাজার হোক, ছেলেটি বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী। তার এটুকু অপরাধ তো ক্ষমা করাই যায়। তবে এই অপরাধ ক্ষমা করার মত কোমলতা কয়দিন পরেই উবে গেল যখন সে বাংলাদেশের নানা সমস্যা আর দুর্বলতা নিয়ে আলাপ জমাতে এলো। এখন লাইব্রেরিতে এলে সে বই পড়ার চেয়ে নীরার সাথে বাংলাদেশের দুর্বল দিকগুলোর কথা বলে নাক সিঁটকাতে বেশি পছন্দ করে। মার্টিন জানে নীরা বাঙালি। নীরার রাগ হয়। বাংলাদেশকে নিয়ে এতই যদি সমস্যা তার তো এসব বই পড়ে নাক সিঁটকানোর কী দরকার বাপু! বসে বসে ব্রিটিশ ইতিহাস পড়লেই হয়।
.
আজ আবার নতুন কী কাহিনি ফেঁদে এনেছে কে জানে! সুন্দর বিকেলটাই মাটি। বরাবরের মতই লাফাতে লাফাতে এসে হাজির হয় মার্টিন নীরার ডেস্কের সামনে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত ঝাপটে 'হেইইই নীঈর্যা' বলে চেঁচিয়ে ওঠে।
কপাল কুঁচকে তাকায় সে বিরক্তিকর ছেলেটির দিকে। কিন্তু ছেলেটি বিরক্ত ভাবের দিকে খেয়ালই করে না । এক দলা থুথু ছিটিয়ে হড়বড় করে বলে, বাহ! তোমাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে তো। এপ্রিলের প্রথম উইকএন্ড কেমন কাটলো নীঈর্যা? নিজের নামের বিকৃত উচ্চারণে মেজাজ সপ্তমে ওঠে এবার নীরার। টিস্যু দিয়ে মুখে ছিটে আসা থুথুর ছাঁট মুছে উত্তর দেয়, কেমন কাটলো তা দিয়ে তুমি কী করবে? এমন উত্তরে মার্টিনের কোনো ভাবান্তর হয় না। আবারও হাত নেড়ে হড়বড় করে বলে, এই এপ্রিল মাসে তোমাদের স্পেশাল একটা দিন আছে, তাই না? আমার তো পুরো এপ্রিল মাসটাই খুব ভাল লাগে!
কী বলতে চাচ্ছে মার্টিন নীরা ঠিক বোঝে না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে। মার্টিন আগের চেয়েও বেশি আগ্রহ নিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে, তোমাদের 'পহেলা বৈশাখ' - র কথা বলছি। সেদিন তোমরা খুব আনন্দ করো বুঝি আমাদের হ্যাপি নিউ ইয়ারের মত? তবে আমার কিন্তু হ্যাপি নিউ ইয়ারের চেয়েও এই মাসটাতে বেশি আনন্দ হয়। সারাবছর আমি এপ্রিলের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি। গণিতের তুখোড় ছাত্র ওসব জটিল ক্যালকুলেশন ছেড়ে বাংলাদেশের পেছনে কেন লেগেছে ভেবে কূল পায়না নীরা। বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠেই বলে, আমাদের পহেলা বৈশাখ তো তোমার এত আনন্দ কেন শুনি? এ কথা শুনে মার্টিন যেন একটু থমকায়। মোটা কাঁচের চশমার ওপাশের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দু'টোয় মুহূর্তেই হালকা বিষাদ নেমে আসে। আর কিছু না বলে চুপচাপ রিডিং টেবিলের দিকে চলে যায় সে। নীরার খারাপ লাগে। কথাটা এভাবে না বললেও হতো। এইযে কয়দিন পর পহেলা বৈশাখ, এটা তো সে নিজেই ভুলে বসে আছে। আর ভীনদেশী একটি ছেলের এমন উচ্ছ্বাসকে সে কি নির্মমভাবে থামিয়ে দিল! নিজের প্রতিই লজ্জা হচ্ছে এখন। মার্টিনকে অবশ্যই সরি বলতে হবে।
.
প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে কিছুসময় মেডিটেশন করে নীরা। কখনও এর হেরফের হয় না। কিন্তু আজকে কিছুতেই সে মন স্থির করতে পারছে না। নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ঢাকা শহর ছেড়েছে আজ তিন বছর। বৈশাখের আগে বন্ধুবান্ধব নিয়ে দলবেঁধে শপিং, ক্যাম্পাসে আল্পনা আঁকা, বৈশাখের দিন লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, চুড়ি, টিপ; সকালে পান্তাভাত আর ইলিশ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা - কি একটা সময়ই না ছিল! আর সাথে ছিল কালবৈশাখী ঝড়। বৈশাখের প্রথম ঝোড়ো বৃষ্টিতে বন্ধুরা মিলে কাক ভেজা হয়ে কি পাগলামিই না করেছে! আজ তিন বছর হয়ে গেল সে এসব থেকে যোজন যোজন দূরে। এখন বৈশাখের প্রথম দিনে সে এই নিরেট শহরের চারদেয়ালে বন্দী হয়ে মনে তীব্র হাহাকার নিয়ে কল্পনায় দেশের সেই আকাশ কালো করা ঝোড়ো হাওয়া গা'য়ে মাখতে চায়।
.
মার্টিনের দেখা নেই প্রায় এক সপ্তাহ হলো! লাইব্রেরিতেও আসছে না। নীরা সরি বলার জন্য খুঁজছে তাকে। প্রতিদিন ডিউটিতে গিয়ে কাজের ফাঁকে মার্টিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কিন্তু তার লাল চুলের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। নীরার মনটা বেশ খচখচ করছে। বৈশাখে সেও আনন্দিত হয়। তবে পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে শুধু এই বৈশাখের জন্যই যে কেও আনন্দে থাকতে পারে তাও আবার অবাঙালি এক ছেলে - এ বিষয়টা সত্যিই তাকে অবাক করেছে। সে একটু ভয়ও পাচ্ছে। মার্টিন কি তার আচরণে খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে? এজন্যই কি সে আর লাইব্রেরিতে আসছে না? আর ভাবতে পারে না নীরা। সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে।
.
'হেইইইই নীঈর্যা'! কথাটি শুনে ঝট করে মুখ তুলে তাকায় সে। অবশেষে লালচুলো বানরটা এসেছে! বরাবরের মত নিজস্ব স্টাইলে বলতে থাকে, কেমন আছো নীঈর্যা? তোমার সাথে কতদিন দেখা হয় না বলো তো? খুব ব্যস্ত ছিলাম বুঝলে? এরপর খুব গোপন একটা কথা বলছে এমন ভঙ্গি করে কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে সামনে ঝুঁকে আসে সে। মার্টিনের কথা শুনে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে নীরা। যাক! ছেলেটা তাহলে সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে মন খারাপ করে নেই। মার্টিন গোপন তথ্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলে, দারুণ এক কাজ করে ফেলেছি জানো? কাওকে বলো না কিন্তু আগেই। তোমাকেই প্রথম জানালাম। ১৪ই এপ্রিলে 'ভার্জিল মিডল স্কুল' - এর মাঠে প্রবাসীদের যে 'বৈশাখী মেলা' হবে, সেখানে আমি একটি স্টল দিচ্ছি। তুমি আসবে কিন্তু দেখতে।
কথাগুলো বলে যেমন লাফাতে লাফাতে এসেছিল তেমন ভাবেই চলে গেল নীরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। নীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। পাগল নাকি ছেলেটা!
.
আজ ১৪ই এপ্রিল। দেশে নিশ্চয়ই কত আনন্দ করছে সবাই। রমনা বটমূলে পাগলা হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। সুদূর প্রবাসে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে। এখানে অনেক বাঙালি আছে। প্রাণের উৎসবের ছোঁয়া পেতে তাই তারা নিজেরাই বৈশাখ পালনের আয়োজন করে। ভার্জিল মিডল স্কুল খুব বেশি দূরে না নীরার ওখান থেকে। সেও যাবে শেকড়ের টানে দেশের মানুষগুলোর সাথে আনন্দ করতে। অনেক খুঁজে লাল - সাদা জামদানী একটা শাড়ি পরলো সে। চোখে হালকা কাজল, হাতে ক'খানা রেশমি চুড়ি আর বটুয়া। মেলায় ঢুকেই মনটা ভাল হয়ে গেল তার। প্রাণের দেশের কত মানুষ যে এসেছে! অপরিচিত কিন্তু তারপরও সবাইকে আপন আপন লাগছে। একদম বাঙালিয়ানা থিমে সাজানো পুরো মেলা। মনেই হচ্ছে না এটা সুদূর আমেরিকা। দেশীয় জিনিসের নানা স্টল সে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। হঠাৎ একটা স্টলের সামনে এসে থমকে যায়। লাল পাঞ্জাবি পরা স্টলের মালিক স্বয়ং মার্টিন। পাগলাটে এই ছেলের সেদিনের দাওয়াত তো পাগলামি ভেবে সে ভুলেই বসে আছে। মার্টিন যে সত্যি সত্যি স্টল দেবে সে ভাবতে পারেনি। তবে নীরা আরও অবাক হল যখন মার্টিন তাকে হেসে বলল, শুভ নববর্ষ নীরা। আমার স্টলে তোমাকে স্বাগতম।
অবাঙালি এক ছেলের মুখে পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে নববর্ষের শুভেচ্ছায় আনন্দে নীরার চোখে পানি চলে আসে। আর কি আশ্চর্য! আজকে মার্টিন তাকে নীঈর্যা না বলে নীরা - ই বলেছে। ও এত সুন্দর উচ্চারণ আয়ত্ত করলো কিভাবে!
.
মার্টিনের স্টলটি নানা রকম, নানা রঙের বাঁশের বাঁশি দিয়ে ভর্তি। বেশ ভীড়। নীরা মার্টিনের সাথে কথা শেষ করে অন্য স্টল দেখতে চলে যায়। সবশেষে আবার মার্টিনের স্টলের কাছে এসে দাঁড়ায়। ভীড় অনেকটাই কম এখন। একটু পরই আজকের মত মেলা শেষ হয়ে যাবে। মার্টিন কি সুন্দর করেই না বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখে নীরা। মেলা শেষে সব গুছিয়ে মার্টিন হাসি মুখে এগিয়ে আসে নীরার দিকে। আশ্চর্য! আজকে তো ওর এগিয়ে আসা দেখে বিরক্ত লাগছে না। আর বানরের মত লাফানোও মনে হচ্ছে না। তুমি এমন অদ্ভুত কেন? নীরা জিজ্ঞেস করে। মার্টিনের হাসি হাসি মুখটা একটু মলিন হয়। উদ্ভ্রান্তের মতো বলে, আমার জীবনের একটা গল্প আছে নীরা! আমি তোমাকে বলতে চাই, শুনবে? নীরা একটু কোমলভাবে তাকায় তার দিকে, অবশ্যই শুনবো। চলো ওদিকটায় গিয়ে বসি।
মেলার একধারে কয়েকটা চেয়ার পাতা ছিল। সেখানে গিয়ে বসে দু'জন। মার্টিন তার জীবনের গল্প শুরু করে।
.
মার্টিনের বাবা ব্রিটিশ, মা বাঙালি ছিল। মা বাঙালি হলেও খুব অল্প বয়সে পুরো পরিবার আমেরিকায় চলে আসে। আদবকেতায় সাহেব হলেও মনেপ্রাণে বাঙালিই থেকে যায় তার মা'র পরিবার। মার্টিনের জন্মও এখানে। তবে নানা-নানির জন্য সে বেশ বাঙালি ঘরানার পরিবেশ পেয়েছে। নানি স্বপ্নাতুর চোখে বাংলাদেশের গল্প শোনাতেন ছোটবেলায়। বাংলা ভাষা শিখতে পারেনি মার্টিন কিন্তু দেশের প্রতি টান ঠিকই সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের ঝুম বৃষ্টি, ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, জোনাকি, পহেলা বৈশাখ, কুয়াশাজড়ানো শীতের ভোর, মাঠ - ঘাট - বন্দর সবকিছুই তার কাছে আরাধ্যের বিষয়। সে বাংলাদেশের গল্প শুনে বড় হয়েছে, দুরন্ত কৈশোর পার করেছে। মা'র দেশের সাথে নিবিড়ভাবে বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। বড় কঠিন সে মাতৃত্বের টান।
এরপর মার্টিন একটু লজ্জিত ভঙিতেই বলল, আমি সবসময় বাংলাদেশের বইপত্র ঘেঁটে দেশের দুর্বল দিকগুলো নিয়ে তোমাকে বলি বলে তুমি রাগ করো জানি। কিন্তু আমি কেন করি এসব তা জানো না। আমি এই দেশকে পুরোপুরি জানতে চাই, বুঝতে চাই। এর দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য কাজ করতে চাই। আর তুমি আমার মায়ের দেশের মেয়ে বলেই তোমাকে আমার আরও বেশি ভাল লাগে। তাই তোমাকে এত বিরক্ত করি। নীরা তার কথায় খুব অবাক হয়। বাংলাদেশকে না দেখেও ছেলেটি তার দেশ নিয়ে এভাবে ভাবে! অথচ সে খাঁটি বাঙালি হয়েও কখনও এভাবে ভাবতে পারেনি। এবার নীরা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তুমি ওমন সুন্দর করে শুভ নববর্ষ বলা কীভাবে শিখলে? আর আমার নামটাও? আগের চেয়ে বেশি লজ্জার লালিমা দেখা যায় মার্টিনের মুখে। জবাব দেয়, বাঙালি এক বন্ধুর কাছে শুনে শুনে অনেক চর্চা করে সে কথাগুলো শুদ্ধ উচ্চারণে আয়ত্ত করেছে। কেন যেন নীরার লালচুলো এই বানর ছেলেটির জন্য মায়া লাগতে থাকে।
.
দুইদিন ব্যাপি মেলার আজকে শেষ দিন। গতকালের তুলনায় তাই ভীড়টাও বেশি। মার্টিনের ব্যস্ততার শেষ নেই। নীরা তাকে স্টলের কাজে সাহায্য করছে। সারাদিনের সব প্রোগ্রাম শেষে সমাপনী ঘটে । বেশ রাত হয়েছে। সব গুছিয়ে নেয় দু'জন মিলে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। মার্টিন বলে, সারাদিন তো অনেক সাহায্য করেছো আমাকে। তোমার জন্য একটা গিফট আছে। নীরা হেসে ফেলে। কী গিফট? মার্টিন পকেট থেকে বাংলাদেশের দুইটা এয়ার টিকেট বের করে। নীরা ভীষণরকম সারপ্রাইজড। মার্টিন টিকেট দু'টো নীরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কীভাবে সব ম্যানেজ করলাম কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। শুধু বলো তুমি যাবে তো আমার সাথে? দেশের মাটিতে আমি প্রথম পা এই বৈশাখেই রাখতে চাই।কালবোশেখী ঝোড়ো হাওয়ায় নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চাই। আর হ্যাঁ, অবশ্যই সেটা তোমার মত মায়াবতীর হাত ধরে। তুমি যাবে তো? নীরা ছলছলে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে বিরক্তিকর, লালচুলো ছেলেটির দিকে। তীব্র ভালবাসাময় এ আহ্বান অগ্রাহ্য করার শক্তি তার নেই!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. দারুণ হয়েছে৷ দুস্টু প্রেমের মিস্টি গল্প৷ থ্যাংক ইউ৷

    উত্তরমুছুন

অমার্জিত মন্তব্য কাম্য নয়