New

শ্বেতপত্র

গল্প/চোর/ মাইদুল ইসলাম




সাত আটজন লোক দৌড়াচ্ছে, কেউ মুখ ভ্যাংচি করে গালি দিচ্ছে। আর একজন লুঙ্গী কাছা করতে করতে উরু বের হচ্ছে।
আমি বাইক নিয়ে লোকগুলোকে ওভারটেক করে যাচ্ছিলাম। একজন আমাকে বললো ভাই;
> সামনের ছেলেটা টাকা চুরি করে পালাচ্ছে, যদি একটু ধরতেন উপকার হতো। এগিয়ে গিয়ে ওকে বললাম,
>  তোর নাম কি, 
বলে না..! সাইড নিচ্ছে।
গাড়ি চাপিয়ে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, বললো রমিচ উদ্দিন।
> কত টাকা চুরি করেছিস?
> আরে ভাই আমি চুরি করি নাই..
> তাহলে?
বেচারা হাপিয়ে উঠেছে, ওর দৌড়নোর গতি কমে যাচ্ছে, পেছনের গুলোরও একই অবস্থা..
বললাম,
> আমার বাইকে উঠবি?
> ভাই উপকার হইতো,,
> আমার লাভ কি?
> চা খাওয়াবো ভাই,.!  হাঁপাতে হাঁপাতে... নেন না একটু গাড়িতে..!
> যা চুরি করেছিস ফিফটি ফিফটি,, রাজি!!?
> না ভাই, আপনি যান..!
> তাহলে তোরে ধরে ওদের কাছে নিয়ে যাবো!
> ভাই এক হাজার দিমু..
> ওঠ গাড়িতে...
রমিচ উদ্দিনকে বাইকে নিয়ে ইউ টার্ন করে ওদের কাছে যাচ্ছিলাম, রমিচ উদ্দিন কেঁদে কেঁদে বলছে,
> ভাই, আমার সব টাকা নিয়া নেন, তবুও আমারে ছাইরা দেন..
আমি চুপ করে ওদের অভিমুখে যাচ্ছি, বেচারা আরো কান্নার শব্দ বাড়িয়ে দিলো। পা ধরছে আমি গতি বাড়িয়ে দিয়ে চালাচ্ছি ওরা ওদিকে প্রচন্ড খুশি.!
কিন্তু ওদের কাছে গিয়ে স্লো করে আবার জোরে চালিয়ে যাচ্ছি। রমিচ উদ্দিনের চোখ আনন্দ চক চক করছে।
সোজা রমজান ভাইয়ের সিঙ্গারার দোকানে গাড়ি থামালাম। রমজান ভাই আমাকে দেখে বলছে,
> ভাই, সিঙ্গারা ভালো হবে না, সব গতকালের। আজ খাইয়েন না।
আমি কিছু না বলে রমিচ উদ্দিনের দিকে তাকাতে সে এক হাজার টাকা দিলো। রমিচ উদ্দিনের কাহিনি শোনা যাক এবার।
> রমজান ভাই, দশটা সিঙ্গারা আর আড়াই ইঞ্চি সাইজের ২০ টা কাচা মরিচ দেন..
রমজান মিয়ার বিরবিরানি শুরু হইলো, ১০টা সিঙ্গারা খাইবো, সময় নিবো চার ঘন্টা আর আমার ব্যবসা লাটে তুলবো পোলা পাইন আইলে তাগো ভাগাই দিবো,,!!! আমি বেচুম কেমনে!!!
> রমজান ভাই, সিঙ্গারা দাও,,!
> কইলাম, আইজ কিন্তু মরিচ দিতারুমনা,,
> পেছনের ঝুড়িটা আনো বাইছা নিচ্ছি,,
> হ, আপনেরে ঝুড়ি দিয়া আমি আবার বাজারে যামু মরিচ কিনতে,,!

রমজান ভাইয়ের সিঙ্গারা একদিকে আর একদিকে ইতু থাকলে আমি রমজান ভাইয়ের সিঙ্গারা আগে নেবো। সেদিন ইতু যখন বললো তার বিয়ের আলাপ চলছে, ছেলে পছন্দ করেছে। ইতু আবার সেই ছেলেকে কেঁদে কেটে বলেছে যে আমাকে সে ভালোবাসে তাই সে রাজি না। ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি রমজান ভাইয়ের সিঙ্গারার দোকানে ডাকলাম, সে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা খুঁজছে আমি রমজান ভাইকে গাড়ি দিতে বললাম যেন সে সাইকেলের গ্যারেজে ২০ টাকা দিয়ে পার্ক করে আসে। কিন্তু সমস্যা হলো রমজান ভাই ওসব চার চাকার গাড়ি চালায় না।
যা হোক, ছেলেটা আসলো, বসতে বললাম তার জন্য স্পেশাল সিটের ব্যবস্থা করতে বলায় রমজান ভাই সিঙ্গারা ঢেকে রাখা পেপার দিয়ে বেঞ্চ মুছে দিলো।
আমি বললাম,
> সিঙ্গারা খান
> সরি..?
আমিও চমকে গেলাম, কোন অপরাধ করলাম না তো..! এমন ভাবে সরি বললো যেন সিঙ্গারা নামটি জীবনের প্রথমবার আমার মুখেই শুনেছে.. তবুও বললাম,
> সিঙ্গারা খান, এই সিঙ্গারার টেস্ট জানেন, রমজান ভাইয়ের যদি প্লেন থাকতো তবে এই সিঙ্গারা ক্যালিফোর্নিয়া আর টেক্সাসে দারুন চলতো, খান।
> সে বুড়ো আঙ্গুল, তর্জনি আঙ্গুল আর মধ্যমা দিয়ে এমনভাবে ধরলো যেন ক্যারামের স্ট্রাইক পকেট তাক করছে.!
আমি বললাম ইতু রান্না দারুন করে, মানে সে শুধু রান্না বলতে এই সিঙ্গারা বানানো শিখেছে। সে প্রতিজ্ঞা করেছে সে জীবনে চা'ও বানাবে না, সে শুধু সিঙ্গারা বানাবে, বিয়ের পরেও সে শুধু সিঙ্গারা বানাবে। আমার সাথে বিয়ে না হলে আপত্তি নেই, কিন্তু শর্ত আছে একটা "সিঙ্গারা ছাড়া সে কিছুই রান্না করবে না" আর যদি সময় না পায় তাহলে রমজান ভাইয়ের দোকান থেকে সিঙ্গারা নিয়ে যাবে।

আমি তিনকোনা সিঙ্গারাটা নিলাম, দুই পাটি দাঁতের ফাঁকে রেখে একটা কামড় দিলাম, আর তিনটা আড়াই ইঞ্চি সাইজের মরিচে মরণ কামড় বসালাম।
ছেলেটাকে বললাম;
> বাঁ হাতে এভাবে মরিচের ডাটা ধরতে হয়, ধরুন, ধরুন,,, আরে ভাই ধরুন না,, হ্যা এভাবে, তিন ভাগের একভাগ সমান করে সামনে বাঁ দাঁতের তৃতীয় দন্তে যেন মরিচ পরে তারপর কড়াৎ করে কামড় বসাবেন। রেডি?
এভাবে এক এক করে তাকে পাঁচটি মরিচ খাওয়ালাম আর আমি ১২ টি খেলাম। রমজান ভাইয়ের কাছে মরিচ চাইতেই বললো, মরিচ শেষ।
ছেলেটা বললো,
> ভাই ইতুকে আমার পছন্দ হয়নি।
> কেন পছন্দ হয়নি, সে একটা ভালো মেয়ে, আমি তাকে ভালোবাসি আর আপনি বলছেন তাকে পছন্দ হয়নি? 
ভালোবাসার এতো সুন্দর মানুষকে কেউ যদি বলে পছন্দ হয়নি তবে সত্যি কান্না পায়।
> ভাই সে রান্না পারে  না, আমার একটা ভালো মেয়ে চাই..
> মিয়া, কি বলেন. সে পৃথিবীর একমাত্র একক রেসিপির রন্ধন শিল্পি। সে গুণবতী, রন্ধন শিল্পি। যে আমার পছন্দ সে কোনভাবে কারোরেই অপছন্দের হতে পারে না।
> সরি ভাই, আমি একটু ওয়াশ রুমে যাবো,
এই বলে সামনে গিয়ে হা করে লালা ফেলছিলো। ঝালে চোখ মুখ ফুলে গেছে, রমজান ভাই তাকে একজগ পানি এগিয়ে দিয়ে বলছিলো,
> ভাই, আপনের ভাগ্য ভালো আমি সব মরিচ লুকাই ফেলছি, জীবনে এই এলাকায় আইবেন না, আইলে আমি নিজে আপনের জন্য এক কেজি মরিচ বরাদ্দ রাখমু...

যাই হোক, আমরা রমজান ভাইয়ের সিঙ্গারা খাইতে খাইতে সব গল্প শেষ করলাম মানে রমিচ উদ্দিন জুয়া খেলে যখন সব টাকা হেরে গিয়েছিলো তখন সে বোর্ডে রাখা সব টাকা ছুঁই মেরে নিয়ে দৌড় দিয়েছিলো।

মাস কয়েক পরে আমি পুলিশের গায়ে বাইক তুলে দিয়ে জেলে বন্দি। আমার বাইকও হাজতের বারান্দায়। কাশেম ভাই মানে যাকে এক্সিডেন্ট করেছিলাম তিনি হাসপাতালে পা নিয়ে কাতরাচ্ছে ডান পায়ে রড দিতে হবে। সচিন দা মানে ডাক্তার ভাই ৩ মাসের বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। আমি কাশেম ভাইকে তার পরিবারের সাথে রাখার এতো সুন্দর ব্যবস্থা করে দিলাম সে কিনা আমাকেই জেল থেকে ছাড়তে নিষেধ করেছে, ব্যাপারটা মানতে কান্না পাচ্ছে। আমার চোখে পানি দেখে পুলিশ ভাই বললো,
> ভাই, আপনি কাঁদছেন কেন? 
> কাশেম ভাইটার জন্য খুব মায়া লাগছে, তিনি একজন সুস্থ্য মানুষ ছিলেন, তাকে আমি অসুস্থ বানালাম। তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। একটু দেখার ব্যবস্থা করে দেবেন কিনা..! পুলিশ ভাই ওসি সাহেবের কাছে গেলেন কাশেম ভাইকে দেখার অনুমতি যদি পাওয়া যায়...
এদিকে ওসি সাহেবের আজ বার্থডে উপলক্ষে জেলে থাকা সকলকে কেক খাওয়াবে, তিনি অনুমতি দিলেন। কিন্তু আমার কেক? বিশাল কেকের পাশে কেক কাটার ছুড়ি ছিলো সবাই বেলুন ফুলাতে ব্যস্ত থাকায় আমি ছুড়ি দিয়ে কেকের এক কোনা থেকে আমার ভাগের অংশ কেটে খেতে খেতে পুলিশ ভাইয়ের বাইকের পেছনে উঠলাম।
হাসপাতালে গিয়েই আমি...!
> কাশেম ভাই, আমি এ কি করেছি ভাই, আপনি আমার পা কেটে নিয়ে আপনার পায়ে লাগিয়ে নেবার  ব্যবস্থা করে নিন। আমি আর নিজের পা চাই না,,
কাশেম ভাইয়ের মেয়ে আর তার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমার কান্না দেখে তাদের কান্না থামালো, হাসপাতালের অন্ততঃ ত্রিশজন মানুষ এসে বারান্দা আর রুমের সব জায়গা দখল করে নিলো..! কাশেম ভাই বলছে,
> ভাই আপনার কান্না থামান প্লিজ, যা হওয়ার হয়ে গেছে।
আমার কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেলো, ভাবি এসে আমাকে শান্তনা দিচ্ছে;
> ভাই আপনি তো জেনে বুঝে এক্সিডেন্ট করেননি, তুমি এনাকে ক্ষমা করে দাও,
কাশেম ভাইয়ের মেয়ে বলছে;
> বাবা চাচ্চুকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ..
> আচ্ছা ঠিক আছে, পুলিশ ভাইকে লক্ষ করে বললেন;
> বাহাদুর, এনার ছাড়াবার প্রসিডিউর মেইনটেইন করে ছেড়ে দিও।
> জি স্যার, ঠিক আছে।
আমরা থানায় ফিরলাম রাত একটায়, আমার সব প্রসিডিউর শেষ, বাইক নিতে গিয়ে দেখি বাইক নেই, কেউ জানে না বাইক কোথায়..! সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করলো, পেলো না। আমার মেজাজ হাই, আমি ওসির নামে মামলা দেবো। ওসি বললেন,
> দেখেন, আমরা ব্যাপারটা দেখছি। আপনি বাইক হারানো একটি জিডি করে যান..!

আমি বাসার দিকে হেটে হেটে যাচ্ছি।
ল্যাম্পোস্টের হলুদ আলোয় আমার সাদা পাঞ্জাবী হলুদ দেখাচ্ছে, একটা ফিলিং কাজ করছে। এই গরমের সময়ে যদি হঠাৎ শীত পরতো, কুয়াশায় আমি পথ ভুলে যেতাম আর একা একা গাইতাম "এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো...!"
এসব ভাবতেই পিপি শব্দে হর্ণ বাজিয়ে রমিচ উদ্দিন বলছে;
> ওস্তাদ, বাইকে ওঠেন...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ